মনোরমা বসু শ্রদ্ধা জড়িত একটি নাম একটি অধ্যায় দেশ মাতৃকার তরে এক মহান নারী বিপ্লবীর নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী,সমাজ সেবক,স্বদেশী আন্দোলনে নেত্রী। যিনি সকলের কাছে মনোরমা মাসী নামেই সমধিক পরিচিত। বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী দৃঢ়চেতা পরোপকারী এবং আদর্শ নিষ্ট মনোরমা বসুর সমগ্র জীবন ছিল শোষিত বঞ্চিত দুঃখী সাধারণ মানুষ ও দেশ প্রেমে নিবেদিত। দেশ প্রেম সমাজসেবা ও মানুষের ভালবাসার কারণে তিনি মাসিমা বলে সর্বমহলে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন ।
জন্ম পরিবার ও শিক্ষাঃ- মনোরমা বসু ১৮৯৭ সালের ১৮ ই নভেম্বর বরিশালের বানারীপাড়া থানার নরোত্তমপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।পিতার নাম নীলকন্ঠ রায় মাতা প্রমদা সুন্দরী রায়।তিনি ছিলেন বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান।দশ বছর বয়সে বাবা নীলকন্ঠ রায় মারা যান।অর্থাভাবে প্রাইমারি পাশের পর আর লেখাপড়া হয়নি তাঁর।মাত্র তের বছর বয়সে বিয়ে হয় বরিশালের গৌরনদীর বাঁকাই গ্রামের বিপত্নীক জমিদার চিন্তা হরণ বসুর সাথে।স্বামী ছিলেন উদারমনা প্রগতিশীল।আর দশটা জমিদার বাড়ির মতো ধরাবাধা নিয়ম বা জীবন ছিল না।মুক্তবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তা ও চর্চার অবাধ সুযোগ ছিল।
রাজনৈতিক বিপ্লবী ও সমাজসেবা মুলক কর্মকান্ডঃ-১৯০৮ সালে যখন ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় তখন মাত্র এগার বছর বয়সে তাঁর মনকে স্পর্শ করে যা তখন তাঁর মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। আশৈশব দারিদ্র্য তাঁর কঠোর বিপ্লবী সাধনায় সিদ্ধ হতে সাহায্য করে।স্বামীর প্রত্যক্ষ সমর্থন তিনি স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত ও মানসিক বিকাশের জন্য তিনি জমিদার বাড়ি ছেড়ে বরিশাল শহরে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী রাজনৈতিক প্রচারণা ও তহবিল সংগ্রহ করতে বরিশাল আসেন।তাঁকে দেখতে ও তাঁর বক্তৃতা শুনতে গ্রাম থেকে একদল নারী নিয়ে তিনি বরিশাল গিয়েছিলেন।সেদিন তাঁর পরনের সমস্ত গহনা গান্ধীর তহবিলে দান করেন।গান্ধীর বক্তৃতা ও চারণ কবি মুকুন্দ দাশের গান তাঁকে ভীষন ভাবে প্রভাবিত করে।গান্ধীর সাথে স্বাক্ষাৎ তাঁকে আরো উজ্জীবিত করে।তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বিপ্লবী মনোরমা মাসিমা নামে খ্যাত হয়ে উঠেন। বরিশাল শহরে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন মাতৃ মন্দির।কুমারী মা,স্বামী পরিত্যক্তা,বিপথগামী আশ্রয়হীন নারীদের আশ্রয় স্হল এই নারী মন্দির।
১৯৩০ সালে বরিশালে কংগ্রেস নারী কর্মীদের সাথে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। আইন অমান্য করায় তাঁকে জীবনের প্রথম ছয় মাসের জেল ও ১৫০/= টাকা জরিমানা করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুষ্টি ভিক্ষার চাউল সংগ্রহ করে মাতৃ মন্দিরের শিক্ষা কার্যক্রম সহ যাবতীয় কার্যক্রম চালাতেন।১৯৩৮সালে তিনি কমিউনিস্ট মতবাদে প্রভাবিত হন।১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে বরিশাল আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করে তার সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গার সময়ে এক নাগাড়ে নয় মাস সেখানে কাজ করেন।তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাণী মাতা খ্যাত নাচোলের বিপ্লবী ইলা মিত্র,আবদুল্লা রসুল,ডাঃ রমেশ ব্যানার্জী,ব্যানার্জী বিভা দাশ গুপ্ত,নৃপেন সেন।১৯৪৮ সালে বরিশালে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেট অফিসের সামনে মিছিল ও বিক্ষোভের সময় পুলিশ নারী কর্মীদের উপর লাঠি চার্জ করলে তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। সেদিন গ্রেপ্তার হয়ে বরিশালে দশ মাস বিনা বিচারে কারাগারে কাটান। পরে চার বছরের জেল হয়। জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৫২ সালের ২৫ শে এপ্রিল।১৯৫৩ সালে ৪৩ বছরের সংসার জীবনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর স্বামী আকস্মিক ভাবে মারা যান।পরে ইস্কান্দর মির্জা ও আইয়ুব খানের সময়ে আত্মগোপনে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।১৯৭০ সালের ১২ ই নভেম্বর ( ২৬ শে কার্তিক) দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। তিনি ত্রাণ সংগ্রহ করে দুর্গত অঞ্চলে ছুটে যান।১৯৭০ সালেই মহিলা পরিষদ বরিশালের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুন মাসে ভারতে চলে যান।মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা অর্থ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত হন।দেশ স্বাধীন হলে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন ।১৯৭৪ সালে সোভিয়েত নারী কমিটির আমন্ত্রণে মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে রাশিয়া ভ্রমণ করেন।
সন্মামনাঃ- কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ১৯৯২ সালের ১১ ই মার্চ মরণোত্তর সন্মামনা প্রদান করা হয়।১৯৯৭ সালে শেরেবাংলা পদক,১৯৯৮সালে মহিলা পরিষদ সন্মামনা ( মরণোত্তর) এবং ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কতৃক বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে ২০০১ সালে গঠন করা হয় ” মনোরমা মাসিমা স্মৃতি ট্রাস্ট “।
১৯৮৩ সাল থেকেই বার্ধক্য সহ তাঁর শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।এই মহীয়সী নারী ১৯৮৬ সালের ১৬ ই অক্টোবর বরিশালে মৃত্যুবরণ করেন। আজ প্রয়াস দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রমোদ রঞ্জন সরকার
নিউইয়র্ক/অক্টোবর/১৬/২০২০।