সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খায় নানান গল্প।কোনটার মাথা আছে পা নেই আবার কোনটার মাথামুণ্ডু কিছু নেই তবে আস্ত একটা শরীর আছে। আজ এমন একটি গল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরছি যেটি মানবিকতায় মুহূর্তে ভরপুর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক এভাবেই লিখলেন তার করে যাওয়া ছোট্ট একটি কাজ।কাজটি ছোট হলেও অনেক বৃহৎ। তা কথাগুলো এমন ছিল
গতকাল সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর মসজিদ হতে বেরিয়ে বাসার দিকে হাঁটছিলাম। অনেকগুলো পত্রিকা হাতে একটা কিশোর সামনে এসে বলল,
– স্যার, পত্রিকা নিবেন?
– সন্ধ্যা ৭টায় কি কেউ পত্রিকা বিক্রি করে? সকালেই তো পড়ে ফেলেছি।
– কি করব স্যার। সকালে স্কুলে যাই তাই বের হইতে পারি না। আর এহন বের হইছি, বাসায় ডাউল-চাউল কিছু নাই এইজন্য।
– তুই ১০ টাকার পত্রিকা বেচে চাল-ডাল কিনতে পারবি? এক কেজি চালের দাম কত জানিস?
– জি স্যার, অনেক দাম। ১ কেজি সিদ্ধ মোটা চাউল ৬০-৬৫ ট্যাকা। আর ডাউল ১৪০ ট্যাকা।
– হুম, তুই সারারাত পত্রিকা বিক্রি করলেও চাল-ডাল কিনতে পারবি না।
ছেলেটা মাথা নিচু করল৷ ওর দিকে তাকালাম, পায়ে স্যান্ডেল নেই।
– স্যান্ডেল কই?
– হাঁটতে হাঁটতে ছিইড়া গেসে।
বিল্ডিংয়ের নিচে ওকে নিয়ে বসলাম।
ছেলেটার নাম মেহরাজ। একটা সরকারী স্কুলের ক্লাস সিক্সে পড়ে। বর্তমান পজিশন ৫০ জনের মধ্যে ১০ম।
ওর মা ৩ সন্তান রেখে মারা যায়। মা ওর বাবার ২য় স্ত্রী ছিল। মারা যাওয়ার পর বাবা ১ম স্ত্রীর কাছে ফিরে যায় কয়েক বছর আগে। ওই ঘরেও তার ৩ সন্তান। কিন্তু ২য় ঘরের এই ৩ ভাই-বোনের কোন খবর ওর বাবা কখনো রাখেননি। তাই ওদের বাবা, থেকেও একদম নেই বলা যায়।
ওদের দায়িত্ব নিয়েছে মূলত মেহরাজের খালা। ওই খালার জামাইয়েরও খোঁজ খবর নাই। কোথাও কোন মেয়েকে বিয়ে করে ওর সাথে থাকে৷ খালা মৃত বোনের ৩ সন্তানকে দেখাশুনা করেন। গার্মেন্টসে কাজ করে বেতন পায় ৯ হাজার টাকা। সাড়ে ৩ হাজার যায় মাত্র এক রুমের একটা ঘরভাড়ায়। এত টানাটানির পরেও ওদের ৩ ভাই-বোনকেই সরকারী স্কুলে দেয়া হয়েছে। বাকি টাকা নিয়ে ওরা কিভাবে চলে, ভয়ে আর জিজ্ঞেস করিনি।
একই রুমে ওদের আরেকজন আত্মীয়া থাকে, মেহরাজের নানুর বোন৷ ভদ্রমহিলার নাম জ্যোৎস্না, মেহরাজরা নানু বলেই ডাকে। উনার কোন সন্তান হয়নি, স্বামীও মারা গেছে তাই ওদের সাথে জ্যোৎস্না অভিভাবক হিসেবে থাকেন৷ উনি বিভিন্ন মসজিদের সামনে ভিক্ষা করে অল্পস্বল্প টাকা পান।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়াতে এখন ওদের বাজার মাসের ২০ তারিখের আগেই ফুরিয়ে যায়৷ বাজার বলতে চাল,ডাল, আলু লবণ আর পিঁয়াজ হবে বড়জোর। ডিম পর্যন্ত কিনে খাওয়ার সাধ্য নাই।
মেহরাজকে বললাম,
– নানুর নাম আর মোবাইল নম্বর দে। যদি সব তথ্য ঠিক হয় তাহলে শুকনো বাজারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
মেহরাজ বেশ দ্রুত একটা কাগজে সব ডিটেইলস লিখে দিল। কল দিয়ে কথা বললাম, সব তথ্যই ঠিক দিয়েছে। বললাম,
– আগামীকাল সন্ধ্যা ৭ টার পর আসিস, বাজার রেডি থাকবে।
মেহরাজ আজ বরাবর সময়ে এসে হাজির। ওর জন্য বাজারও রেডি।
উপহার দেয়া হল, ২৫ কেজি চাল, ৫ কেজি ডাল, ৫ কেজি আলু, ২ কেজি পিঁয়াজ, ১ লিটার সয়াবিন তেল, ২টা নূডলস ফ্যামিলি প্যাক, চিড়া, বিস্কুট, রুটি, লবণ ইত্যাদি৷
বাসায় পৌঁছে মেহরাজ আর ওর নানু ফোন করেছিল।
ওরা এই অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ নানু অনেক দোয়া করলেন।
আসলে ওদেরকে উপহার দেয়ার জন্য বেছে নেয়ার কারণ, এত স্বল্প আয় সত্ত্বেও ১০, ১৩ আর ১৫ বছর বয়সী, পরিবারের ৩ জন কিশোর – কিশোরীকে ওরা কাজে লাগিয়ে দেয়নি। আরো ভাল ভবিষ্যতের আশায় স্কুলে পড়ালেখা করাচ্ছে।