বাংলাদেশের ১৭টি গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১৭ গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক দেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ৮টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে কারখানা স্থাপন, কারখানা অধিগ্রহণ ও যৌথ বিনিয়োগ করেছে।
বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ করছে পণ্য বাজারজাত ও অন্যান্য ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লিয়াজোঁ কার্যালয় খোলার জন্য। কারণ, অনেক দেশে পণ্য বিক্রি করতে ওই দেশে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর।
তাই এ দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে তারা সবাই যে বিদেশে কারখানা করছে তেমন নয়। রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে রপ্তানিকারক দেশগুলোতে নানা কাজে বিদেশে অর্থ খরচ করতে হয়। তাই অনেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে কারখানা করার পাশাপাশি লিয়াজোঁ কার্যালয় খুলছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দেশে বেসরকারি খাত বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পণ্য বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দিতে বাজারজাত একটি বড় মাধ্যম। এ জন্য দেশের বাইরে অনেকে অফিস খুলছে, এটা ভালো। এর বাইরে যারা কারখানায় বিনিয়োগ করছে, তাদের অভিজ্ঞতা দেখতে হবে। এরপরই নতুন করে অনুমোদন দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বিদেশে যেসব অর্থ ব্যয় হবে, তার তদারকি জোরদার করতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তৎপরতা বাড়াতে হবে।
বর্তমানে শুধু এ দেশের রপ্তানিকারকেরা তাদের রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) রক্ষিত বিদেশি মুদ্রা থেকে একটি অংশ বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশে বিনিয়োগসংক্রান্ত আবেদন পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটি (প্রপোজাল ইভ্যালুয়েশন কমিটি) যাচাই–বাছাই করে আবেদনগুলো সরকারের কাছে পাঠাত। এরপর সরকার থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হতো।
কিন্তু বিদেশে এ দেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পথ সহজ করতে গত ১৬ জানুয়ারি দেশে মূলধনী হিসাব লেনদেন (বিদেশে ইক্যুইটি বিনিয়োগ) বিধিমালা, ২০২২ জারি হয়। এ বিধিমালা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেবে। এর ফলে নতুন করে যারা আবেদন করবে, তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এই কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন না দিলেও অর্থ দেশ থেকে চলে যাবে। তাই বৈধ পথে টাকা বিনিয়োগ হলে সেটাই বরং ভালো। এতে কিছুটা হলেও জবাবদিহি থাকবে। এ জন্য বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। এখন পর্যন্ত যারা অনুমোদন পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিদেশে কারখানা স্থাপন, অধিগ্রহণ বা যৌথ বিনিয়োগ করেছে কমই। যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে কারখানায় বিনিয়োগ করছে, তাদের মধ্যে মিয়ানমারে ২০১৩ মবিল যমুনা যৌথ উদ্যোগে প্রথম কারখানা করে, তবে ব্যবসায়িক অস্থিরতায় ইতিমধ্যে সেই বিনিয়োগ ফেরত এনেছে। এরপর ডিবিএল গ্রুপ ৯৫ লাখ ডলার বা ৮২ কোটি টাকা খরচ করে ইথিওপিয়ায় পোশাক কারখানা করে, সেটিও ভালো করতে পারছে না। স্কয়ার গ্রুপ আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় ওষুধ কারখানা করতে ১ কোটি ডলার বা ৮৬ কোটি নিয়েছে। আর কেনিয়ায় যৌথ উদ্যোগে ইস্পাত (স্টিল) কারখানা করতে ৪৬ লাখ ডলার বা ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে বিএসআরএম স্টিল।
আকিজ জুট মিলস ২ কোটি ডলার বা ১৭২ কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় প্রক্রিয়াজাত কাঠ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী দুটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। প্রাণ ফুডস ভারতের পিনাকল ফোরএস কোম্পানিতে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৬৬৫ ডলার বা ১৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। তারা বিনিয়োগ করছে খাদ্য উৎপাদন কারখানায়। নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এজে সুপার গার্মেন্টস সৌদি আরবে সিটি অব ড্রিমস ফর ডেটস কোম্পানির খেজুরের ব্যবসায় ৫০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় ওষুধ কারখানা স্থাপনের জন্য বেক্সিমকো ফার্মা ৬০ লাখ ডলার বা ৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন পেলেও প্রক্রিয়াটি থমকে গেছে বলে জানা গেছে।
আর এর বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে, তারা মূলত বিদেশে কার্যালয় খুলবে। ফলে তাদের অনুমোদন হওয়া অর্থের পরিমাণও কম। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যালয় খুলেছে এসিআই হেলথকেয়ার। স্কয়ার ফার্মা কার্যালয় খুলেছে যুক্তরাজ্য ও ফিলিপাইনে। এস্তোনিয়া ও যুক্তরাজ্যে কার্যালয় খুলেছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। রেনাটা ফার্মা কার্যালয় খুলেছে আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এ দেশের রপ্তানিকারকদের অনেকেই এখন অনুমোদন নিয়ে বিদেশে কার্যালয় স্থাপন বা কারখানা করতে আগ্রহী। আবার অনেকে অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে অর্থ নিয়ে কোম্পানি খুলে ব্যবসা করছেন, বিপুল সম্পদও গড়ে তুলেছেন।
বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশে সম্পদ ও বিনিয়োগ থাকাটা এখন মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার পরবর্তী প্রজন্ম পড়াশোনা ও পরিবার নিয়ে বিদেশে থাকে। এ জন্য এক রকম বাধ্য হয়ে বিদেশে ব্যবসা বাড়াতে হচ্ছে। (প্রথম আলো সংবাদ )