ঢাকা ১০:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ নয়নতারা মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত শ্যামনগরে হরিণের মাংস সহ আটক দুই সাতক্ষীরা সাস্থ্য উন্নয়ন কমিটির বর্ধিত সভায় ২৬ অক্টোবর খুলনা রোড মোড় মানব বন্ধনের সিদ্ধান্ত খুলনা প্রেসক্লাবে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি উপ-পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান অনুষ্ঠিত  কালিগঞ্জে তরুন দলের কমিটি গঠন সভাপতি সুলতান,সম্পাদক আলতাপ পানি নিষ্কাশনে ইউএনও,র প্রাণপণ চেষ্টা অব্যহত তালার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন আবারও পানিবন্ধী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সঃ কে কটুক্তির প্রতিবাদে রূপসা বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত

বাঙলা নামের উদ্ভব ও বিবর্তন’- রানা চক্রবর্তী

  • Sound Of Community
  • পোস্ট করা হয়েছে : ০৪:২৩:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৩
  • ৯৩ জন পড়েছেন ।

সাউন্ড অব কমিউনিটি :
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের আগে পর্যন্ত বাঙালীর আবাসভূমিকে বলা হত ‘বঙ্গদেশ’, ইংরেজিতে বলা হত ‘বেঙ্গল’। ‘বেঙ্গল’ নামটা দিয়েছিল ইংরেজরা। তাঁরা এটা নিয়েছিল পর্তুগীজদের দেওয়া ‘বেঙ্গালা’ শব্দ থেকে। পর্তুগীজদের ‘বেঙ্গালা’ শব্দটি আবার মুসলমানদের দেওয়া ‘বঙ্গালহ্’ শব্দের রূপান্তর মাত্র। ১৫২৮ সাল নাগাদ পাঠান সুলতানরাই প্রথম ‘বঙ্গালহ্’ শব্দের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তবে তার আগেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর দু’জন বৈদেশিক পর্যটক ‘মার্কো পোলো’ ও ‘রশিদুদ্দিন’ তাঁদের ভ্রমণকাহিনীতে ‘বঙ্গাল’ নামটা ব্যবহার করেছিলেন। ১৫৭৬ সালে মোঘল সম্রাট ‘আকবর’ যখন বাঙলা অধিকার করেছিলেন তখন থেকে ‘বঙ্গাল’ শব্দটা আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল। তবে প্রাক্-মুসলমান যুগে ‘বঙ্গাল’ বলতে পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাংশের এক অঞ্চল-বিশেষকে বোঝানো হত। এটা ‘বঙ্গ’ শব্দের ঠিক সমার্থবোধক ছিল না। কেননা, ঐতিহাসিকরা সেই একই সময়ে ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’ – এই দুই ভিন্ন অংশের বিদ্যমানতা লক্ষ্য করেন৷ ‘বঙ্গ’ শব্দ দ্বারা বাঙলার এক ব্যাপক অংশকে বোঝাত, যেটার অবস্থিতি ছিল ভাগীরথীর পূর্বদিকে। ভাগীরথীর পশ্চিমাংশকে বলা হত ‘রাঢ়দেশ’। রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমাংশে ছিল ‘অঙ্গদেশ’ ও দক্ষিণে ছিল ‘কলিঙ্গ’। ‘বঙ্গ’ কোন ভাষার শব্দ তা আজও জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘গঙ্গা’ প্রভৃতি শব্দ ‘প্রাগার্য তিব্বতীয় উৎস’ থেকে উদ্ভূত। অনেকে আবার ‘বঙ্গ’ শব্দটি ‘মুণ্ডারী’ ভাষার শব্দ বলে মনে করেন। এখানে উল্লেখনীয় যে ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গাল’ ও ‘বঙ্গানী’ শব্দগুলি ‘চর্যাগীতে’ পাওয়া যায়।
প্রথমে ‘বঙ্গ’ শব্দটি ছিল এক ‘কৌমগোষ্ঠী’র নাম। পরে সেটা ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কৌমগোষ্ঠীর নাম হিসাবে ‘বঙ্গ’ নামটির সঙ্গে বৈদিক যুগের আর্যরাও পরিচিত ছিলেন। ‘ঐতরেয়ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে প্রথম বঙ্গের নাম পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে বঙ্গবাসীদের ‘বয়াংসি’ বা পক্ষিজাতীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। বোধ হয় পক্ষিবিশেষ তাঁদের ‘টোটেম’ ছিল। আরও যাঁদের নাম বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, তাঁরা হচ্ছেন ‘পুণ্ড্র’। ‘ঐতরেয়ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে ‘পুণ্ড্র’দের ‘দ্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। মোট কথা, বৈদিক সাহিত্যে ঐতিহাসিকরা বঙ্গদেশের অধিবাসীদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ্য করেন। এমনকি, ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রের’ যুগ পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা সেই বিদ্বেষ অব্যাহত দেখেছেন। ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ অনুযায়ী ‘পুণ্ড্র’দের অবস্থিতি ছিল উত্তরবঙ্গে, আর ‘বঙ্গ’দের অবস্থিতি ছিল মধ্যপূর্ববঙ্গে। ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ তাঁদের ‘আর্যাবর্তের বাইরের লোক’ বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, আর্যদের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে পৃথক ছিল। তবে তাঁদের দেবতাগণকে কেন্দ্র করে বঙ্গদেশে অনেক তীর্থস্থান ছিল, এবং আর্যরাও সেই সব তীর্থস্থান দর্শন করতে আসতেন। ঐতিহাসিকরা এর আভাস ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ পান। কিন্তু ‘রামায়ণ-মহাভারত’ রচনার যুগ থেকে ঐতিহাসিকরা বঙ্গদেশের লোকেদের প্রতি আর্যদের বিদ্বেষভাব আর দেখতে পান না। ‘মহাভারত’ রচনার যুগে ‘বঙ্গ’, ‘কর্বট’, ‘সুহ্ম’ প্রভৃতি জনপদের নাম পাওয়া যায়। জৈনদের প্রাচীনতম ধর্মপুস্তক ‘আচারাঙ্গসূত্রে’ ঐতিহাসিকরা ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশের নামেরও উল্লেখ পেয়েছেন। সেখানে রাঢ়দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছিল – ‘বজ্জভূমি’ (বজ্রভূমি) ও ‘সুব্বভূমি’ (সুহ্মভূমি)। ‘বৌদ্ধ জাতক’ গ্রন্থসমূহেও ‘সুহ্ম’দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া, প্রাক্‌-বৌদ্ধ যুগের দুই জনপদের নামও প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায় – ‘শিবি’ ও ‘চেত’। ‘আলেকজাণ্ডার’ যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তখন তিনি গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত ‘গঙ্গারিড’ বা ‘গঙ্গারাঢ়’ দেশের লোকদের শৌর্যবীর্যের কথা শুনেই ‘বিপাশা নদী’র তীর থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘প্লিনি’, ‘টলেমি’ ও অন্যান্য গ্রীসদেশীয় লেখকগণও ‘গঙ্গারাঢ়’ দেশের উল্লেখ করেছিলেন। এর সঙ্গে প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে ‘প্রাসাই’ বা প্রাচ্যদেশের কথা শুনতে পাওয়া যায়। প্রাচ্যদেশের কথা ‘পাণিনি’ও উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। ‘টলেমি’ বঙ্গদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদীর পাঁচটি শাখার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। সেই গঙ্গানদীর ওপরে অবস্থিত ‘গঙ্গা’ নামের এক বাণিজ্যকেন্দ্রেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই নামটা ‘পেরিপ্লাস অভ দি ইরিথ্রিয়ান সী’ নামক প্রাচীন গ্রন্থেও উল্লিখিত হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পরবর্তী কালে যেটা বাঙালীর আবাসভূমি ‘বঙ্গদেশ’ নামে অভিহিত হত, সেটা প্রাচীনকালে বহু জনগোষ্ঠীর আবাসস্থান হয়ে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল। অন্তর্বর্তী কালে সেগুলোর অনেক নাম ছিল, যথা – ‘গৌড়’, ‘বঙ্গ’, ‘সমতট’, ‘চন্দ্রদ্বীপ’, ‘বঙ্গাল’, ‘পুণ্ড্র’, ‘বরেন্দ্র’, ‘রাঢ়’, ‘তাম্রলিপ্ত’, ‘বারক’, ‘কঙ্কগ্রাম’, ‘বর্ধমান’, ‘কজঙ্গল’, ‘দণ্ডভুক্তি’, ‘খাড়ি’, ‘নাব্য’ ইত্যাদি। সেগুলোর ভৌগোলিক সীমারেখা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ছিল। ভাগীরথীকে সীমারেখা ধরলে তার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল ‘কজঙ্গল’, ‘রাঢ়’, ‘কঙ্কগ্রাম’, ‘কর্বট’, ‘সুহ্ম’, ‘তাম্রলিপ্ত’ ও ‘দণ্ডভূক্তি’। আর তার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছিল ‘পুণ্ড্র’, ‘গৌড়’ ও ‘বরেন্দ্র’; মধ্যভাগে ছিল ‘বঙ্গ’, ও দক্ষিণে ছিল ‘হরিকেল’, ‘সমতট’, ‘বঙ্গাল’, ‘খাড়ি’ ও ‘নাব্য’। শেষোক্ত অঞ্চলগুলি পূর্ববাঙলার দক্ষিণাংশের উপকূলবর্তী দেশ ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই উত্তরবঙ্গ ‘মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত’ হয়েছিল। এর সপক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা হল, উত্তরবঙ্গের ‘বগুড়া’ জেলার ‘মহাস্থানগড়ে’ প্রাপ্ত মৌর্যযুগের ‘ব্রাহ্মী’ অক্ষরে লিখিত ও ‘প্রাকৃত’ ভাষায় রচিত এক লিপি। তবে সমগ্র বঙ্গদেশ যে মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল, তার সপক্ষে কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না (তুলনীয় ‘নোয়াখালি’ জেলার ‘শিলুয়া’য় প্রাপ্ত ‘ব্রাহ্মী’ অক্ষরে ও ‘প্রাকৃত’ ভাষায় লিখিত এক মূর্তিলেখ)। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্ভবতঃ ‘গুপ্তসম্রাট’ ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের’ সময়েই সমগ্র বঙ্গদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং বঙ্গদেশে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ঘটেছিল। তবে তখনও বঙ্গদেশের অংশবিশেষ, যথা – ‘সমতট’ যে প্রত্যন্ত রাজ্যভুক্ত ছিল তার প্রমাণ ঐতিহাসিকরা ‘এলাহাবাদের স্তম্ভলিপি’তে পেয়েছেন। কিন্তু যদিও গুপ্তসম্রাটগণের আমলে বঙ্গদেশের অধিকাংশ অঞ্চলই একত্রিত হয়েছিল, তবুও গুপ্তসম্রাট ‘স্কন্দগুপ্তের’ পরে যখন গুপ্তসাম্রাজ্যের ভাঙন ঘটেছিল, তথন বঙ্গদেশের বিভিন্ন অংশে স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে উঠেছিল। খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাতখানা ‘তাম্রশাসন’ থেকে সেই রাজ্যের তিনজন ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিধারী রাজার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হচ্ছেন – ‘ধর্মাদিত্য’, ‘গোপচন্দ্র’ ও ‘সমাচারদেব’। তাঁদের এলাকাভুক্ত ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’ (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলা)। সেটাই তখনকার দিনের ‘বঙ্গরাজ্য’ ছিল। সম্ভবতঃ সেটাকেই কেন্দ্র করে খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজ ‘শশাঙ্ক’ ‘গৌড়সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে বঙ্গদেশে ‘মাৎস্যন্যায়’-এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সেই অরাজকতার হাত থেকে, খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধাভাগে (৭৫০ খ্রী) বঙ্গদেশকে উদ্ধার করেছিলেন ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ কর্তৃক মনোনীত পালসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘গোপাল’। নবম ও দশম শতাব্দীর লিপিসমূহ থেকে জানতে পারা যায় যে, পালযুগের শেষভাগে বঙ্গদেশ ‘উত্তর’ ও ‘অনুত্তর’ – এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীতে দক্ষিণ বাঙলায় ‘চন্দ্রদ্বীপ’ (বাখরগঞ্জ জেলায়) নামেও এক রাজা ছিলেন। সেই রাজ্যের ‘তাম্রশাসন’ থেকে – ‘লডহচন্দ্র’ ও ‘গোবিন্দচন্দ্র’ নামে দুই রাজার নাম পাওয়া যায়। সেনরাজগণের আমলেও বঙ্গদেশ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – ‘বিক্রমপুর ভাগ’ ও ‘নাব্য’। একাদশ শতাব্দীর লিপিসমূহেই ঐতিহাসিকরা প্রথম ‘বঙ্গাল’ দেশের উল্লেখ পান। সেই ‘বঙ্গাল’ শব্দই মুসলমান যুগে বঙ্গদেশকে ‘বঙ্গাল’ নামে অভিহিত করতে সহায়তা করেছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের সেটা ছিল ‘পূর্বতম সুবা’ এবং সেটার বিস্তৃতি ছিল ‘ভাগীরথীর পূর্বপ্রান্ত’ থেকে ‘চট্টগ্রাম’ পর্যন্ত। রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘টোডরমল’ কর্তৃক ১৫৮২ সালে প্রণীত ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ নামক তালিকা অনুযায়ী সম্রাট আকবরের সময় বঙ্গদেশ ‘১৯টি সরকারে’ বিভক্ত ছিল। তার অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘৬৮৯টি মহাল’। বঙ্গদেশ থেকে দিল্লীর মুঘলদরবারে প্রেরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ‘১০,৬৯,৩৬৭ আকবরশাহী টাকা’। সম্রাট ‘ঔরঙ্গজেবের’ সময় নতুন নতুন অঞ্চল জয়ের পর ওই তালিকা সংশোধিত হয়েছিল। তখন বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল – ‘হিজলি’, ‘মেদিনীপুর’, ‘জলেশ্বর’, ‘কোচবিহারের অংশবিশেষ’, ‘পশ্চিম আসাম’, ‘ত্রিপুরা’, ‘ছোটনাগপুরের অংশবিশেষ’ ও ‘সুন্দরবন’। সেই পরিবর্ধিত তালিকায় বঙ্গদেশকে ‘৩৪টি সরকারে’ বিভক্ত দেখতে পাওয়া যায়। তখন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘১৩৫০টি মহাল’ এবং রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ‘১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা’।
ইতিহাসের ‘গৌড়’ নামটিও বেশ প্রাচীন। পণ্ডিতমহল মনে করেন যে, এক সময় বঙ্গদেশে প্রচুর পরিমাণে ‘ইক্ষু’র চাষ হত ও তা থেকে ‘গুড়’ উৎপাদন হত এবং সেই ‘গুড়’ থেকেই ‘গৌড়’ নামের উৎপত্তি হয়েছিল। ‘কৌটিল্যের’ ‘অর্থশাস্ত্র’-এ গৌড়দেশের পণ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ‘বাৎস্যায়নের’ ‘কামসূত্র’-এও গৌড় রাজ্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু ইতিহাসে গৌড়ের প্রথম অভ্যুত্থান ঘটেছিল গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কিছু আগে। খ্রীস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘বরাহমিহির’ তাঁর ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে গৌড়কে বাঙলার অংশবিশেষ বলে বর্ণনা করেছিলেন। বাঙলার অপর অংশগুলির তিনি যে নাম করে গিয়েছিলেন, সেগুলি হছে – ‘গৌড়ক’, ‘পুণ্ড্র’, ‘তাম্রলিপ্তিক’, ‘বঙ্গ’, ‘সমতট’ ও ‘বর্ধমান’। সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘মৌখরীরাজ’ ‘ঈশানবর্মা’র ‘হরহা শিলালেখে’ সমুদ্রযাত্রায় পারদর্শী গৌড়গণের সঙ্গে তাঁর বিবাদের কথা পাওয়া যায়। ‘ভবিষ্যপুরাণে’ গৌড়দেশকে বর্ধমানের উত্তরে ও পদ্মার দক্ষিণে অবস্থিত বলা হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে ‘অনর্ঘ-রাঘব’ গ্রন্থের লেখক ‘মুরারি মিশ্র’ লিখে গিয়েছিলেন যে, গৌড়ের রাজধানী ছিল ‘চম্পা’য়। অনেকের মতে ‘মদারণ সরকারের’ অন্তর্ভুক্ত ‘চম্পানগরী’ ও ‘চম্পা’ অভিন্ন। সেটার অবস্থিতি ছিল দামোদর নদের তীরে বর্ধমানের উত্তর পশ্চিমে। ইতিহাসে যখন গৌড়ের অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তখন গৌড়দেশ বলতে পশ্চিম বাঙলার ‘মালদহ-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল’কেই বোঝাতো। বস্তুতঃ খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সুযোগে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত (বহরমপুরের নিকট ভাগীরথী তীরস্থ) প্রাচীন ‘কর্ণসুবর্ণ’ নগরকে কেন্দ্র করেই স্বাধীন গৌড়রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা ‘শশাঙ্ক’ গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি মধ্য ও ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বাঙলা’ ও ‘উড়িষ্যা’র কিছু অংশ নিজের রাজ্যভুক্ত করে গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি ‘মগধ’ও অধিকার করেছিলেন। সেই সময় শশাঙ্ক ‘মালবের’ উত্তরকালীন গুপ্তরাজগণের সঙ্গে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ‘মালবরাজ’ ‘দেবগুপ্তের’ সহায়তায় ‘মৌখরীরাজ’ ‘গ্রহবর্মা’কে পরাজিত ও নিহত করে ‘কান্যকুব্জ’ জয় করেছিলেন। তার আগে ‘মালবরাজের’ সহায়তায় ‘শশাঙ্ক’ ‘কামরূপের’ ‘সুস্থিতবর্মা’ ও তাঁর পুত্রদের পরাজিত করে ‘কামরূপ’ও অধিকার করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই ‘গ্রহবর্মা’র শ্যালক ‘থানেশ্বরাধিপতি’ ‘হর্ষবর্ধন’ ‘কামরূপরাজ’ ‘ভাস্করবর্মা’র সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে ‘উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে’ নিজের আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন। তখন কিছুকালের জন্য ‘গৌড়রাজ’ তাঁদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ‘হর্ষবর্ধন’ ও ‘ভাস্করবর্মা’র মৃত্যুর পরে ‘গৌড়রাজ’ আবার নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে গৌড় রাজ্যের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটেছিল। বিস্তৃত স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের ফলে গৌড় নূতন মর্যাদা লাভ করেছিল। তার ফলে ওই সময় ‘গৌড়ীয় ভাষা ও কাব্যরচনা-রীতির প্রসিদ্ধি’ ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত ‘গৌড়রাজ’ ‘মগধেশ্বর’ উপাধি বহন করতেন। শেষ পর্যন্ত ‘কান্যকুব্জরাজ’ যশোবর্মা’ ‘মগধেশ্বর’ গৌড়রাজকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। এরপরেই বাঙলায় অরাজকতা দেখা দিয়েছিল এবং পরে ‘পালরাজগণের’ অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পালরাজগণকে ‘গৌড়’, ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’দেশের (‘আবুল ফজলের’ মতে, ‘বঙ্গ’ + ‘আল’ = ‘বঙ্গাল’) অধীশ্বর বলা হত। ‘দ্বিতীয় পালরাজ’ ‘ধর্মপাল’ ‘উত্তরপ্রদেশ’ পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ‘লক্ষ্মণসেন’কে পরাজিত করে মুসলমানরা যখন বঙ্গদেশ অধিকার করেছিলেন, তখন তাঁরা নিজেদের ‘গৌড়রাজ’ বলে অভিহিত করতেন। ১৫৭৬ সালে মুঘলসম্রাট ‘আকবর’ বঙ্গদেশ অধিকার করেছিলেন এবং সেই সঙ্গেই গৌড়ের রাজনৈতিক সত্তা বিলুপ্ত হয়েছিল। তখন থেকেই সমগ্র বঙ্গদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গাল’ নাম ধারণ করেছিল। বাঙলা তখন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী ২০ বছর বাঙলা মুঘল সম্রাটগণের অধীনে ছিল।
১৭৫৭ সালে ‘পলাশীর যুদ্ধের’ পরে বাঙলা ইংল্যাণ্ডের ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’র হাতে চলে গিয়েছিল। ১৮৫৮ সালে বঙ্গদেশ সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে এসেছিল। মুঘলদের দেওয়া নামের অনুকরণে ‘পর্তুগীজ’রা বঙ্গদেশকে ‘Bengala’ নামে অভিহিত করত। ইংরেজদের হাতে যাওয়ার পরে সেই নাম বদলে হয়েছিল ‘Bengal’| ইংরেজ শাসনাধীনে নানা সময় এর আয়তন ও সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৮৬৭ সালে ‘ভারত সরকারের ১৭৫৮ নং আদেশ’ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তখন ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ ভারত ১২টি বিভিন্ন শাসন বিভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – (১) বেঙ্গল, (২) বোম্বে, (৩) মাদ্রাজ, (৪) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, (৫) পঞ্জাব, (৬) আসাম (১৮৬৭ সালে বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল), (৭) মধ্যপ্রদেশ, (৮) ব্রিটিশ ব্রহ্ম, (৯) বেরার, (১০) মহীশুর ও কুর্গ, (১১) রাজপুতানা এবং (১২) মধ্যভারত। সুতরাং ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত বাঙলার আয়তন ছিল ‘পাঞ্জাবের পূর্বসীমান্ত থেকে ব্রিটিশ-ব্রহ্মের সীমান্ত’ পর্যন্ত। তার মানে, ১৮৬৭ সালে – ‘যুক্তপ্রদেশ’, ‘বিহার ও উড়িষ্যা’ এবং ‘আসাম’ বাঙলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু নানারকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। তাকে ক্রমণ ছোট করে আনা হয়েছিল ‘বঙ্গ’, ‘আসাম’, ‘বিহার’, ‘উড়িষ্যা’ ও ‘ছোটনাগপুরে’। তারপর ‘আসাম’ প্রদেশকেও পৃথক করে একজন ‘চীফ কমিশনারের শাসনাধীনে’ ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১৯০৩ সালে ‘মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার’ ‘স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার’ প্রস্তাব করেছিলেন যে, বঙ্গদেশকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করা হোক। সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। ‘আসাম’, ‘ঢাকা বিভাগ’, ‘চট্টগ্রাম বিভাগ’, ‘পার্বত্যত্রিপুরা’, ‘দার্জিলিং’ ও সমগ্র ‘রাজশাহী বিভাগ’ একত্রিত করে ‘পূর্ববঙ্গ’ – ও ‘আসাম’ নামে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেশব্যাপী ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় ‘সম্রাট পঞ্চম জর্জ’ নিজেই, ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর, ‘দিল্লী দরবারে’ ঘোষণার দ্বারা ‘বঙ্গভঙ্গ’ রহিত করেছিলেন। এর ফলে ‘দার্জিলিং’, ‘ঢাকা-বিভাগ’, ‘চট্টগ্রাম-বিভাগ’ ও ‘রাজশাহী বিভাগ’সমূহকে পুনরায় বাঙলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘বিহার’ ও ‘উড়িষ্যা’ তখন থেকে স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়েছিল ও ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে ‘দিল্লী’তে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের শর্ত হিসাবে বাঙলাকে আবার দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল – ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘পূর্ব-পাকিস্তান’। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়েছিল৷ বাংলাদেশের বর্তমান আয়তন ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের আগে বাঙলার মোট আয়তন ছিল ৭৭,৫২১ বর্গমাইল৷ স্বাধীনতালাভের পরে পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তন দাঁড়িয়েছিল ৩৩,৯২৮ বর্গমাইল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বঙ্গ’ নাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু তা আর কার্যকর হয়নি।

(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, ডঃ অতুল সুর।
২- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- বাঙ্গলার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
৪- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।

Tag :
রিপোর্টার সম্পর্কে

Sound Of Community

জনপ্রিয় সংবাদ

আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ

বাঙলা নামের উদ্ভব ও বিবর্তন’- রানা চক্রবর্তী

পোস্ট করা হয়েছে : ০৪:২৩:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৩

সাউন্ড অব কমিউনিটি :
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের আগে পর্যন্ত বাঙালীর আবাসভূমিকে বলা হত ‘বঙ্গদেশ’, ইংরেজিতে বলা হত ‘বেঙ্গল’। ‘বেঙ্গল’ নামটা দিয়েছিল ইংরেজরা। তাঁরা এটা নিয়েছিল পর্তুগীজদের দেওয়া ‘বেঙ্গালা’ শব্দ থেকে। পর্তুগীজদের ‘বেঙ্গালা’ শব্দটি আবার মুসলমানদের দেওয়া ‘বঙ্গালহ্’ শব্দের রূপান্তর মাত্র। ১৫২৮ সাল নাগাদ পাঠান সুলতানরাই প্রথম ‘বঙ্গালহ্’ শব্দের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তবে তার আগেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর দু’জন বৈদেশিক পর্যটক ‘মার্কো পোলো’ ও ‘রশিদুদ্দিন’ তাঁদের ভ্রমণকাহিনীতে ‘বঙ্গাল’ নামটা ব্যবহার করেছিলেন। ১৫৭৬ সালে মোঘল সম্রাট ‘আকবর’ যখন বাঙলা অধিকার করেছিলেন তখন থেকে ‘বঙ্গাল’ শব্দটা আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল। তবে প্রাক্-মুসলমান যুগে ‘বঙ্গাল’ বলতে পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাংশের এক অঞ্চল-বিশেষকে বোঝানো হত। এটা ‘বঙ্গ’ শব্দের ঠিক সমার্থবোধক ছিল না। কেননা, ঐতিহাসিকরা সেই একই সময়ে ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’ – এই দুই ভিন্ন অংশের বিদ্যমানতা লক্ষ্য করেন৷ ‘বঙ্গ’ শব্দ দ্বারা বাঙলার এক ব্যাপক অংশকে বোঝাত, যেটার অবস্থিতি ছিল ভাগীরথীর পূর্বদিকে। ভাগীরথীর পশ্চিমাংশকে বলা হত ‘রাঢ়দেশ’। রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমাংশে ছিল ‘অঙ্গদেশ’ ও দক্ষিণে ছিল ‘কলিঙ্গ’। ‘বঙ্গ’ কোন ভাষার শব্দ তা আজও জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘গঙ্গা’ প্রভৃতি শব্দ ‘প্রাগার্য তিব্বতীয় উৎস’ থেকে উদ্ভূত। অনেকে আবার ‘বঙ্গ’ শব্দটি ‘মুণ্ডারী’ ভাষার শব্দ বলে মনে করেন। এখানে উল্লেখনীয় যে ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গাল’ ও ‘বঙ্গানী’ শব্দগুলি ‘চর্যাগীতে’ পাওয়া যায়।
প্রথমে ‘বঙ্গ’ শব্দটি ছিল এক ‘কৌমগোষ্ঠী’র নাম। পরে সেটা ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কৌমগোষ্ঠীর নাম হিসাবে ‘বঙ্গ’ নামটির সঙ্গে বৈদিক যুগের আর্যরাও পরিচিত ছিলেন। ‘ঐতরেয়ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে প্রথম বঙ্গের নাম পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে বঙ্গবাসীদের ‘বয়াংসি’ বা পক্ষিজাতীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। বোধ হয় পক্ষিবিশেষ তাঁদের ‘টোটেম’ ছিল। আরও যাঁদের নাম বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, তাঁরা হচ্ছেন ‘পুণ্ড্র’। ‘ঐতরেয়ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে ‘পুণ্ড্র’দের ‘দ্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। মোট কথা, বৈদিক সাহিত্যে ঐতিহাসিকরা বঙ্গদেশের অধিবাসীদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ্য করেন। এমনকি, ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রের’ যুগ পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা সেই বিদ্বেষ অব্যাহত দেখেছেন। ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ অনুযায়ী ‘পুণ্ড্র’দের অবস্থিতি ছিল উত্তরবঙ্গে, আর ‘বঙ্গ’দের অবস্থিতি ছিল মধ্যপূর্ববঙ্গে। ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ তাঁদের ‘আর্যাবর্তের বাইরের লোক’ বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, আর্যদের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে পৃথক ছিল। তবে তাঁদের দেবতাগণকে কেন্দ্র করে বঙ্গদেশে অনেক তীর্থস্থান ছিল, এবং আর্যরাও সেই সব তীর্থস্থান দর্শন করতে আসতেন। ঐতিহাসিকরা এর আভাস ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ পান। কিন্তু ‘রামায়ণ-মহাভারত’ রচনার যুগ থেকে ঐতিহাসিকরা বঙ্গদেশের লোকেদের প্রতি আর্যদের বিদ্বেষভাব আর দেখতে পান না। ‘মহাভারত’ রচনার যুগে ‘বঙ্গ’, ‘কর্বট’, ‘সুহ্ম’ প্রভৃতি জনপদের নাম পাওয়া যায়। জৈনদের প্রাচীনতম ধর্মপুস্তক ‘আচারাঙ্গসূত্রে’ ঐতিহাসিকরা ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশের নামেরও উল্লেখ পেয়েছেন। সেখানে রাঢ়দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছিল – ‘বজ্জভূমি’ (বজ্রভূমি) ও ‘সুব্বভূমি’ (সুহ্মভূমি)। ‘বৌদ্ধ জাতক’ গ্রন্থসমূহেও ‘সুহ্ম’দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া, প্রাক্‌-বৌদ্ধ যুগের দুই জনপদের নামও প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায় – ‘শিবি’ ও ‘চেত’। ‘আলেকজাণ্ডার’ যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তখন তিনি গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত ‘গঙ্গারিড’ বা ‘গঙ্গারাঢ়’ দেশের লোকদের শৌর্যবীর্যের কথা শুনেই ‘বিপাশা নদী’র তীর থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘প্লিনি’, ‘টলেমি’ ও অন্যান্য গ্রীসদেশীয় লেখকগণও ‘গঙ্গারাঢ়’ দেশের উল্লেখ করেছিলেন। এর সঙ্গে প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে ‘প্রাসাই’ বা প্রাচ্যদেশের কথা শুনতে পাওয়া যায়। প্রাচ্যদেশের কথা ‘পাণিনি’ও উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। ‘টলেমি’ বঙ্গদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদীর পাঁচটি শাখার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। সেই গঙ্গানদীর ওপরে অবস্থিত ‘গঙ্গা’ নামের এক বাণিজ্যকেন্দ্রেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই নামটা ‘পেরিপ্লাস অভ দি ইরিথ্রিয়ান সী’ নামক প্রাচীন গ্রন্থেও উল্লিখিত হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পরবর্তী কালে যেটা বাঙালীর আবাসভূমি ‘বঙ্গদেশ’ নামে অভিহিত হত, সেটা প্রাচীনকালে বহু জনগোষ্ঠীর আবাসস্থান হয়ে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল। অন্তর্বর্তী কালে সেগুলোর অনেক নাম ছিল, যথা – ‘গৌড়’, ‘বঙ্গ’, ‘সমতট’, ‘চন্দ্রদ্বীপ’, ‘বঙ্গাল’, ‘পুণ্ড্র’, ‘বরেন্দ্র’, ‘রাঢ়’, ‘তাম্রলিপ্ত’, ‘বারক’, ‘কঙ্কগ্রাম’, ‘বর্ধমান’, ‘কজঙ্গল’, ‘দণ্ডভুক্তি’, ‘খাড়ি’, ‘নাব্য’ ইত্যাদি। সেগুলোর ভৌগোলিক সীমারেখা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ছিল। ভাগীরথীকে সীমারেখা ধরলে তার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল ‘কজঙ্গল’, ‘রাঢ়’, ‘কঙ্কগ্রাম’, ‘কর্বট’, ‘সুহ্ম’, ‘তাম্রলিপ্ত’ ও ‘দণ্ডভূক্তি’। আর তার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছিল ‘পুণ্ড্র’, ‘গৌড়’ ও ‘বরেন্দ্র’; মধ্যভাগে ছিল ‘বঙ্গ’, ও দক্ষিণে ছিল ‘হরিকেল’, ‘সমতট’, ‘বঙ্গাল’, ‘খাড়ি’ ও ‘নাব্য’। শেষোক্ত অঞ্চলগুলি পূর্ববাঙলার দক্ষিণাংশের উপকূলবর্তী দেশ ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই উত্তরবঙ্গ ‘মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত’ হয়েছিল। এর সপক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা হল, উত্তরবঙ্গের ‘বগুড়া’ জেলার ‘মহাস্থানগড়ে’ প্রাপ্ত মৌর্যযুগের ‘ব্রাহ্মী’ অক্ষরে লিখিত ও ‘প্রাকৃত’ ভাষায় রচিত এক লিপি। তবে সমগ্র বঙ্গদেশ যে মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল, তার সপক্ষে কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না (তুলনীয় ‘নোয়াখালি’ জেলার ‘শিলুয়া’য় প্রাপ্ত ‘ব্রাহ্মী’ অক্ষরে ও ‘প্রাকৃত’ ভাষায় লিখিত এক মূর্তিলেখ)। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্ভবতঃ ‘গুপ্তসম্রাট’ ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের’ সময়েই সমগ্র বঙ্গদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং বঙ্গদেশে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ঘটেছিল। তবে তখনও বঙ্গদেশের অংশবিশেষ, যথা – ‘সমতট’ যে প্রত্যন্ত রাজ্যভুক্ত ছিল তার প্রমাণ ঐতিহাসিকরা ‘এলাহাবাদের স্তম্ভলিপি’তে পেয়েছেন। কিন্তু যদিও গুপ্তসম্রাটগণের আমলে বঙ্গদেশের অধিকাংশ অঞ্চলই একত্রিত হয়েছিল, তবুও গুপ্তসম্রাট ‘স্কন্দগুপ্তের’ পরে যখন গুপ্তসাম্রাজ্যের ভাঙন ঘটেছিল, তথন বঙ্গদেশের বিভিন্ন অংশে স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে উঠেছিল। খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাতখানা ‘তাম্রশাসন’ থেকে সেই রাজ্যের তিনজন ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিধারী রাজার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হচ্ছেন – ‘ধর্মাদিত্য’, ‘গোপচন্দ্র’ ও ‘সমাচারদেব’। তাঁদের এলাকাভুক্ত ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’ (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলা)। সেটাই তখনকার দিনের ‘বঙ্গরাজ্য’ ছিল। সম্ভবতঃ সেটাকেই কেন্দ্র করে খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজ ‘শশাঙ্ক’ ‘গৌড়সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে বঙ্গদেশে ‘মাৎস্যন্যায়’-এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সেই অরাজকতার হাত থেকে, খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধাভাগে (৭৫০ খ্রী) বঙ্গদেশকে উদ্ধার করেছিলেন ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ কর্তৃক মনোনীত পালসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘গোপাল’। নবম ও দশম শতাব্দীর লিপিসমূহ থেকে জানতে পারা যায় যে, পালযুগের শেষভাগে বঙ্গদেশ ‘উত্তর’ ও ‘অনুত্তর’ – এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীতে দক্ষিণ বাঙলায় ‘চন্দ্রদ্বীপ’ (বাখরগঞ্জ জেলায়) নামেও এক রাজা ছিলেন। সেই রাজ্যের ‘তাম্রশাসন’ থেকে – ‘লডহচন্দ্র’ ও ‘গোবিন্দচন্দ্র’ নামে দুই রাজার নাম পাওয়া যায়। সেনরাজগণের আমলেও বঙ্গদেশ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – ‘বিক্রমপুর ভাগ’ ও ‘নাব্য’। একাদশ শতাব্দীর লিপিসমূহেই ঐতিহাসিকরা প্রথম ‘বঙ্গাল’ দেশের উল্লেখ পান। সেই ‘বঙ্গাল’ শব্দই মুসলমান যুগে বঙ্গদেশকে ‘বঙ্গাল’ নামে অভিহিত করতে সহায়তা করেছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের সেটা ছিল ‘পূর্বতম সুবা’ এবং সেটার বিস্তৃতি ছিল ‘ভাগীরথীর পূর্বপ্রান্ত’ থেকে ‘চট্টগ্রাম’ পর্যন্ত। রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘টোডরমল’ কর্তৃক ১৫৮২ সালে প্রণীত ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ নামক তালিকা অনুযায়ী সম্রাট আকবরের সময় বঙ্গদেশ ‘১৯টি সরকারে’ বিভক্ত ছিল। তার অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘৬৮৯টি মহাল’। বঙ্গদেশ থেকে দিল্লীর মুঘলদরবারে প্রেরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ‘১০,৬৯,৩৬৭ আকবরশাহী টাকা’। সম্রাট ‘ঔরঙ্গজেবের’ সময় নতুন নতুন অঞ্চল জয়ের পর ওই তালিকা সংশোধিত হয়েছিল। তখন বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল – ‘হিজলি’, ‘মেদিনীপুর’, ‘জলেশ্বর’, ‘কোচবিহারের অংশবিশেষ’, ‘পশ্চিম আসাম’, ‘ত্রিপুরা’, ‘ছোটনাগপুরের অংশবিশেষ’ ও ‘সুন্দরবন’। সেই পরিবর্ধিত তালিকায় বঙ্গদেশকে ‘৩৪টি সরকারে’ বিভক্ত দেখতে পাওয়া যায়। তখন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ‘১৩৫০টি মহাল’ এবং রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ‘১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা’।
ইতিহাসের ‘গৌড়’ নামটিও বেশ প্রাচীন। পণ্ডিতমহল মনে করেন যে, এক সময় বঙ্গদেশে প্রচুর পরিমাণে ‘ইক্ষু’র চাষ হত ও তা থেকে ‘গুড়’ উৎপাদন হত এবং সেই ‘গুড়’ থেকেই ‘গৌড়’ নামের উৎপত্তি হয়েছিল। ‘কৌটিল্যের’ ‘অর্থশাস্ত্র’-এ গৌড়দেশের পণ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ‘বাৎস্যায়নের’ ‘কামসূত্র’-এও গৌড় রাজ্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু ইতিহাসে গৌড়ের প্রথম অভ্যুত্থান ঘটেছিল গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কিছু আগে। খ্রীস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘বরাহমিহির’ তাঁর ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে গৌড়কে বাঙলার অংশবিশেষ বলে বর্ণনা করেছিলেন। বাঙলার অপর অংশগুলির তিনি যে নাম করে গিয়েছিলেন, সেগুলি হছে – ‘গৌড়ক’, ‘পুণ্ড্র’, ‘তাম্রলিপ্তিক’, ‘বঙ্গ’, ‘সমতট’ ও ‘বর্ধমান’। সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘মৌখরীরাজ’ ‘ঈশানবর্মা’র ‘হরহা শিলালেখে’ সমুদ্রযাত্রায় পারদর্শী গৌড়গণের সঙ্গে তাঁর বিবাদের কথা পাওয়া যায়। ‘ভবিষ্যপুরাণে’ গৌড়দেশকে বর্ধমানের উত্তরে ও পদ্মার দক্ষিণে অবস্থিত বলা হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে ‘অনর্ঘ-রাঘব’ গ্রন্থের লেখক ‘মুরারি মিশ্র’ লিখে গিয়েছিলেন যে, গৌড়ের রাজধানী ছিল ‘চম্পা’য়। অনেকের মতে ‘মদারণ সরকারের’ অন্তর্ভুক্ত ‘চম্পানগরী’ ও ‘চম্পা’ অভিন্ন। সেটার অবস্থিতি ছিল দামোদর নদের তীরে বর্ধমানের উত্তর পশ্চিমে। ইতিহাসে যখন গৌড়ের অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তখন গৌড়দেশ বলতে পশ্চিম বাঙলার ‘মালদহ-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল’কেই বোঝাতো। বস্তুতঃ খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সুযোগে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত (বহরমপুরের নিকট ভাগীরথী তীরস্থ) প্রাচীন ‘কর্ণসুবর্ণ’ নগরকে কেন্দ্র করেই স্বাধীন গৌড়রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা ‘শশাঙ্ক’ গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি মধ্য ও ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বাঙলা’ ও ‘উড়িষ্যা’র কিছু অংশ নিজের রাজ্যভুক্ত করে গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি ‘মগধ’ও অধিকার করেছিলেন। সেই সময় শশাঙ্ক ‘মালবের’ উত্তরকালীন গুপ্তরাজগণের সঙ্গে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ‘মালবরাজ’ ‘দেবগুপ্তের’ সহায়তায় ‘মৌখরীরাজ’ ‘গ্রহবর্মা’কে পরাজিত ও নিহত করে ‘কান্যকুব্জ’ জয় করেছিলেন। তার আগে ‘মালবরাজের’ সহায়তায় ‘শশাঙ্ক’ ‘কামরূপের’ ‘সুস্থিতবর্মা’ ও তাঁর পুত্রদের পরাজিত করে ‘কামরূপ’ও অধিকার করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই ‘গ্রহবর্মা’র শ্যালক ‘থানেশ্বরাধিপতি’ ‘হর্ষবর্ধন’ ‘কামরূপরাজ’ ‘ভাস্করবর্মা’র সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে ‘উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে’ নিজের আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন। তখন কিছুকালের জন্য ‘গৌড়রাজ’ তাঁদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ‘হর্ষবর্ধন’ ও ‘ভাস্করবর্মা’র মৃত্যুর পরে ‘গৌড়রাজ’ আবার নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে গৌড় রাজ্যের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটেছিল। বিস্তৃত স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের ফলে গৌড় নূতন মর্যাদা লাভ করেছিল। তার ফলে ওই সময় ‘গৌড়ীয় ভাষা ও কাব্যরচনা-রীতির প্রসিদ্ধি’ ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত ‘গৌড়রাজ’ ‘মগধেশ্বর’ উপাধি বহন করতেন। শেষ পর্যন্ত ‘কান্যকুব্জরাজ’ যশোবর্মা’ ‘মগধেশ্বর’ গৌড়রাজকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। এরপরেই বাঙলায় অরাজকতা দেখা দিয়েছিল এবং পরে ‘পালরাজগণের’ অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পালরাজগণকে ‘গৌড়’, ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’দেশের (‘আবুল ফজলের’ মতে, ‘বঙ্গ’ + ‘আল’ = ‘বঙ্গাল’) অধীশ্বর বলা হত। ‘দ্বিতীয় পালরাজ’ ‘ধর্মপাল’ ‘উত্তরপ্রদেশ’ পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ‘লক্ষ্মণসেন’কে পরাজিত করে মুসলমানরা যখন বঙ্গদেশ অধিকার করেছিলেন, তখন তাঁরা নিজেদের ‘গৌড়রাজ’ বলে অভিহিত করতেন। ১৫৭৬ সালে মুঘলসম্রাট ‘আকবর’ বঙ্গদেশ অধিকার করেছিলেন এবং সেই সঙ্গেই গৌড়ের রাজনৈতিক সত্তা বিলুপ্ত হয়েছিল। তখন থেকেই সমগ্র বঙ্গদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গাল’ নাম ধারণ করেছিল। বাঙলা তখন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী ২০ বছর বাঙলা মুঘল সম্রাটগণের অধীনে ছিল।
১৭৫৭ সালে ‘পলাশীর যুদ্ধের’ পরে বাঙলা ইংল্যাণ্ডের ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’র হাতে চলে গিয়েছিল। ১৮৫৮ সালে বঙ্গদেশ সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে এসেছিল। মুঘলদের দেওয়া নামের অনুকরণে ‘পর্তুগীজ’রা বঙ্গদেশকে ‘Bengala’ নামে অভিহিত করত। ইংরেজদের হাতে যাওয়ার পরে সেই নাম বদলে হয়েছিল ‘Bengal’| ইংরেজ শাসনাধীনে নানা সময় এর আয়তন ও সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৮৬৭ সালে ‘ভারত সরকারের ১৭৫৮ নং আদেশ’ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তখন ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ ভারত ১২টি বিভিন্ন শাসন বিভাগে বিভক্ত ছিল, যথা – (১) বেঙ্গল, (২) বোম্বে, (৩) মাদ্রাজ, (৪) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, (৫) পঞ্জাব, (৬) আসাম (১৮৬৭ সালে বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল), (৭) মধ্যপ্রদেশ, (৮) ব্রিটিশ ব্রহ্ম, (৯) বেরার, (১০) মহীশুর ও কুর্গ, (১১) রাজপুতানা এবং (১২) মধ্যভারত। সুতরাং ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত বাঙলার আয়তন ছিল ‘পাঞ্জাবের পূর্বসীমান্ত থেকে ব্রিটিশ-ব্রহ্মের সীমান্ত’ পর্যন্ত। তার মানে, ১৮৬৭ সালে – ‘যুক্তপ্রদেশ’, ‘বিহার ও উড়িষ্যা’ এবং ‘আসাম’ বাঙলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু নানারকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। তাকে ক্রমণ ছোট করে আনা হয়েছিল ‘বঙ্গ’, ‘আসাম’, ‘বিহার’, ‘উড়িষ্যা’ ও ‘ছোটনাগপুরে’। তারপর ‘আসাম’ প্রদেশকেও পৃথক করে একজন ‘চীফ কমিশনারের শাসনাধীনে’ ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১৯০৩ সালে ‘মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার’ ‘স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার’ প্রস্তাব করেছিলেন যে, বঙ্গদেশকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করা হোক। সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। ‘আসাম’, ‘ঢাকা বিভাগ’, ‘চট্টগ্রাম বিভাগ’, ‘পার্বত্যত্রিপুরা’, ‘দার্জিলিং’ ও সমগ্র ‘রাজশাহী বিভাগ’ একত্রিত করে ‘পূর্ববঙ্গ’ – ও ‘আসাম’ নামে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেশব্যাপী ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় ‘সম্রাট পঞ্চম জর্জ’ নিজেই, ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর, ‘দিল্লী দরবারে’ ঘোষণার দ্বারা ‘বঙ্গভঙ্গ’ রহিত করেছিলেন। এর ফলে ‘দার্জিলিং’, ‘ঢাকা-বিভাগ’, ‘চট্টগ্রাম-বিভাগ’ ও ‘রাজশাহী বিভাগ’সমূহকে পুনরায় বাঙলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘বিহার’ ও ‘উড়িষ্যা’ তখন থেকে স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়েছিল ও ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে ‘দিল্লী’তে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের শর্ত হিসাবে বাঙলাকে আবার দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল – ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘পূর্ব-পাকিস্তান’। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়েছিল৷ বাংলাদেশের বর্তমান আয়তন ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের আগে বাঙলার মোট আয়তন ছিল ৭৭,৫২১ বর্গমাইল৷ স্বাধীনতালাভের পরে পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তন দাঁড়িয়েছিল ৩৩,৯২৮ বর্গমাইল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বঙ্গ’ নাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু তা আর কার্যকর হয়নি।

(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, ডঃ অতুল সুর।
২- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- বাঙ্গলার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
৪- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।