ঢাকা ০২:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ নয়নতারা মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত শ্যামনগরে হরিণের মাংস সহ আটক দুই সাতক্ষীরা সাস্থ্য উন্নয়ন কমিটির বর্ধিত সভায় ২৬ অক্টোবর খুলনা রোড মোড় মানব বন্ধনের সিদ্ধান্ত খুলনা প্রেসক্লাবে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি উপ-পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান অনুষ্ঠিত  কালিগঞ্জে তরুন দলের কমিটি গঠন সভাপতি সুলতান,সম্পাদক আলতাপ পানি নিষ্কাশনে ইউএনও,র প্রাণপণ চেষ্টা অব্যহত তালার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন আবারও পানিবন্ধী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সঃ কে কটুক্তির প্রতিবাদে রূপসা বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত

গল্প বার্মার লোককাহিনি- বদরুল হাসান

  • Sound Of Community
  • পোস্ট করা হয়েছে : ০১:৫৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল ২০২৩
  • ১১৬ জন পড়েছেন ।

বদরুল হাসান

বার্মায় বসবাসকালে (অক্টোবর ২০১৪-ডিসেম্বর ২০১৭) সেখানকার সমৃদ্ধ লোককাহিনির সাথে নানাভাবে পরিচিত হই। কখনোবা ইংরেজিতে লেখা বই ও ভ্রমণের সময় বিমানের সিটপকেটে রাখা ইন-ফ্লাইট ম্যাগাজিন পড়ে, কখনো তথ্যবাতায়ন ঘেঁটে, আবার কখনো লোকমুখে শুনে বেশ কিছু লোককাহিনি সংগ্রহ করেছিলাম। সেখান থেকে এই সাতটি গল্প পাঠকের জন্য পরিবেশন করা হলো।
প্রথম গল্প ‘একতাই বল’ একটি কাচিন লোককাহিনি। কাচিন মায়ানমারের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি স্টেট। গল্পটি এয়ার ক্যাম্বোজা বিমানে ভ্রমণের সময় সরবরাহ করা ইনফ্লাইট ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত। তিন ঘণ্টার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে উড়ে চলার সময় মোবাইল ফোনের নোটস অ্যাপে অনুবাদটি করা হয়েছিল। পরে আমার মেয়ে জোহারিন মুনাজ্জা দশ বছরে পা দেবার আগেই আলোহা নামের একটি গণিত শিক্ষাকেন্দ্রে যোগ দিয়েছিল শিক্ষক-সহযোগী হিসেবে। তার প্রথম মাসের বেতন পাওয়াকে উপলক্ষ করে গল্পটি তাকে উৎসর্গ করেছিলাম।
‘নারিকেল গাছের ইতিবৃত্ত’, ‘এক যে বোকা বালক’, ‘বাগানে এত বিপুল সংখ্যক প্যাগোডা কোথা থেকে এলো?’, ‘কাক কেন কোকিলছানা লালন করে? আর প্যাঁচাই বা কেন কেবল রাতবিরাতে বের হয়?’ গল্প চারটি মং টিন অং রচিত বার্মিজ ফোকটেলস গ্রন্থ অবলম্বনে অনূদিত। বাগান বিশ্বের অন্যতম প্রত্নতাত্বিক পর্যটন এলাকা। এখানে প্যাগোডার সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের অধিক। কিন্তু কেমন করে এত প্যাগোডা ওখানে তৈরি হয়েছিল এ নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে রয়েছে বিশদ আলোচনা। ‘বাগানে এতসংখ্যক প্যাগোডা কোথা থেকে এলো?’ গল্পটিতে সে রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি পোপা পর্বত আর বাগানের এক ভিক্ষু রসায়নবিদের পরশপাথর আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। এই গল্পটি নিয়ে বার্মিজ ভাষায় নাটক ও গীতিনাট্য উপস্থাপিতও হয়, যা বেশ জনপ্রিয়।
‘ইনলে হ্রদের অতিথির মাছ খাওয়া’ গল্পটি ইনলে হ্রদে ভ্রমণকালে আমাদের গাইড আর-কারের মুখ থেকে শোনা। ঐতিহাসিকভাবে বার্মায় দারিদ্র্য বিদ্যমান। বিশেষত জলাবদ্ধ, পাহাড়ি আর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় দারিদ্র্য ভীষণ প্রকট। শ্যান স্টেটে ১১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইনলে হ্রদের চারদিকে রয়েছে ৭০ হাজার মানুষের বসতি। হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বার্মার অনন্য পর্যটন। রয়েছে ভাসমান রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, প্যাগোডা এবং বাজার। হ্রদে ভাসমান এমনই একটি রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন ভোজনে মাছ খাওয়ার সময় আমাদের গাইড-বন্ধু আর-কার এই প্রচলিত গল্পটি বলেছিল। গল্পটি বলে সে যোগ করেছিল, ‘ধরে নিন এটি আমার জীবনেরই কাহিনি!’ দারিদ্র্য বার্মার সাধারণ জনসাধারণকে অতিথি বিমুখ করে তোলে নি। এটি ঠিক সেরকম একটি গল্প।
‘নাগিন, সূর্য আর সাদা কাকের গল্প’টি ক্যাথি এস মজলি (Cathy S Mosely)-এর ইংরেজি বর্ণনা থেকে বাংলায় রূপান্তরিত। এই গল্পে এক সময়ের সাদা কাক কী করে চিরতরে কালো হলো তাই বিধৃত হয়েছে।

১.
একতাই বল: কাচিন সংস্করণ
নদীর ধারে একটি ব্যাঙ বিষণ্ন মনে বসে ছিল। কোথা থেকে এক মতলববাজ বাঘ এসে হাজির। উদ্দেশ্য ব্যাঙের স্বাদ গ্রহণ করা আর কী! কিন্তু, এমনি এমনি ব্যাঙ ধরে খেয়ে ফেলায় আনন্দ নেই। বাঘ বলে কথা! সে ভাবলো একটু ব্যাঙকে খেলিয়ে নেয়া যাক। তারপর না হয় মজা করে খাবো।
বাঘ: কি হে ভায়া মন খারাপ নাকি?
বাঘকে দেখে ব্যাঙ ভয় লুকানো চেষ্টা করলো। নিজেকে আড়াল করতে না পেরে আমতা আমতা করে আলাপ শুরু করলো।
ব্যাঙ: না, না মন খারাপ হবে কেন! এমনি বসে আছি। ভাবছি নদীটা কি করে পার হব।
বাঘ: তুমি তো ঐ ছোটো পাহাড়টাতেই চরতে পারবে না আর এই বিশাল নদী পার হবে কি করে?
ব্যাঙ: এ আর এমনকি লাফিয়ে লাফিয়ে আমি সহজেই কত পাহাড়ে উঠে যাই।
বাঘ: তবে হয়ে যাক এক হাত, দেখি কে আগে ওই পাহাড়ে উঠতে পারে?
বাঘ দৌড় দিতেই ব্যাঙ এক লাফে তার লেজের শেষাংশ ধরে ঝুলে রইলো। আর পাহাড়ে বাঘ পা ফেলার আগেই টপ করে লাফিয়ে নেমে গেলো। দুষ্টবুদ্ধি বাঘ হেরে গিয়ে নতুন ফন্দি আঁটলো।
বাঘ: আচ্ছা, তুমি তো জিতে গেছো। তাহলে চলো দেখি আগে কে নদীটা পার হতে পারে? তুমি আগে পার হলে আমাকে খেয়ে ফেলবে; আর আমি জিতলে তোমাকে খাবো।
এতো মহাবিপদ দেখছি! ব্যাঙ একটু ভেবে নিল।
ব্যাঙ: ঠিক আছে তবে সাত দিন পরে। আর আমার একটা শর্ত আছে, নদী পার হবার সময় আমরা দুজনেই ডাকতে ডাকতে পার হবো।
বাঘ তাতেও রাজি। ভাবলো মন্দ কি সাত দিন পরেই না হয় ব্যাঙের মাংস খেলাম।
প্রাণে বাঁচতে মরিয়া ব্যাঙ বুদ্ধি আঁটলো। বন-জলের সব ব্যাঙকে ডেকে বসলো বৈঠকে। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে হলে একযোগে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো নদীর পানিতে এপার-ওপার কিছুদূর পরপর একেকটি ব্যাঙ ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকবে। প্রথম ব্যাঙের ডাক শোনার পর তারা একে একে ডেকে চলবে। বাঘ পৌঁছানোর আগেই শেষের ব্যাঙ ওপারে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে থাকবে ‘জিতে গেছি, জিতে গেছি।’
ঐক্যবদ্ধ ব্যাঙ দলের শক্তির কাছে বুদ্ধির জোরে শক্তিধর বাঘ হেরে গেলো। আর বিজয়ী ব্যাঙেরা সুযোগ পেলো একটা বাঘ খেয়ে ফেলার।

২.
নারিকেল গাছের ইতিবৃত্ত
অনেক অনেক দিন আগের কথা। বার্মায় একবার তিনজন লোক ভেলায় চরে উপকূলে এসে নামলো। এদের একজন ছিল চোর, আরেকজন ডাইনি, আর শেষজন অনর্থক কলহ সৃষ্টিকারী। অপরাধের শাস্তি হিসেবে নিজ দেশের রাজা তাদের ভেলায় ভাসিয়ে বিতারিত করেছে।
উপকূলে ইতস্তত এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে তিনজনকে বার্মা রাজার লোকেরা ধরে রাজদরবারে হাজির। অকপটে রাজা ও সভাসদকে তারা নিজেদের অপকর্মের শাস্তির কথা জানিয়ে দিল। সব জেনেশুনে রাজা চোর এবং ডাইনি এই দুজনের প্রত্যেককে দিলেন এক সহস্র রৌপ্যমুদ্রা আর একটি করে বসত বাড়ি। আর কলহ সৃষ্টিকারীকে দিলেন মৃত্যুদণ্ড। রাজার সভাসদ এমন সিদ্ধান্তের কারণ কি জানতে চাইলেন। রাজা জানালেন, দারিদ্র্যের শিকার হয়ে চোর চুরি করতো। এখন তার দারিদ্র্য থাকবে না তাই সে আর চুরিও করবে না। আর ডাইনি কেবল অপরের সম্পদ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ভয় দেখালেও কারো ক্ষতি করতো না। সেও তো দরিদ্র। এখন তো তার দারিদ্র্য থাকবে না, তাই সে আর কাউকে ভয়ও দেখাবে না। কিন্তু, এই কলহসৃষ্টিকারী অকারণে মানুষের মধ্যে বিবাদ-ফ্যাসাদ লাগায়। ও তো ভালো হবার নয়, তাই মৃত্যুদণ্ডই ওর প্রাপ্য। জল্লাদের খড়গে যথারীতি কলহসৃষ্টিকর্তার ধর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূমিতে পতিত রইলো।
পরদিন একই পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাজার এক অমাত্য। পরে থাকা মৃত মস্তক তাকে দেখে কথা বলে উঠলো। সে বললো, ‘এই তোর রাজাকে গিয়ে বল এখানে এসে আমার কাছে হাত জোড় করে মাথা নত করতে। নইলে আমি ওর ধর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করবো।’ অমাত্য ত্রস্তপদে প্রাসাদে পৌঁছে রাজা ও সভাসদকে ঘটনাটি জানালো। কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করলো না। রাজা ভাবলো তাকে নিয়ে মজা করতে এই কল্পকাহিনি। লোকটি তখন নিরুপায় হয়ে তার সঙ্গে কাউকে পাঠানোর অনুরোধ জানালো। অতঃপর, একজন কর্তাকে সাথে নিয়ে অমাত্য পরে থাকা মস্তকটির দেখতে গেল। কিন্তু, একি! এ মস্তক তো কোনো কথাই বলছে না আর! নাখোশ রাজা অমাত্যের মস্তক কর্তনের আদেশ দিলেন। জল্লাদ ওই কর্তাব্যক্তির সামনেই অমাত্যের শিরোচ্ছেদ করলো ঠিক একই বধ্যভূমিতে।
কিন্তু হায়, আবার সেই দুরাত্মার দেহবিহীন মাথা কথা বলতে শুরু করেছে। এবার সে অট্টহাস্যে বলছে, ‘হা হা হা! আমার দেহে প্রাণ নেই তো কি হয়েছে, এখনো আজেবাজে গালগল্প বানিয়ে বলে অনিষ্ঠ করতে আমি যথেষ্ট পারঙ্গম!’ এই কর্তা বুঝতে পারলেন কি অবিচারই না অমাত্যের প্রতি করা হয়েছে। তৎক্ষণাত তিনি রাজাকে সবিস্তারে বিষয়টি জানালেন।
রাজা বুঝতে পারলো এই ছিন্নমস্তক না জানি আরো কত কি অনিষ্ঠ করে ফেলে! তাই তার আদেশে মাথাটি মাটিতে পুতে ফেলা হলো। পরদিন, মস্তক পোতা জায়গায় একটি আজব গাছ জন্মালো, যার ফল দেখতে অবিকল ওই কলহ সৃষ্টিকর্তার মস্তকের অনুরূপ!
সেই থেকে আপনি কোনো নারিকেল কানের কাছে নিয়ে নাড়ালে ভিতরের গড়গড় শব্দ শুনতে পাবেন। বুঝতেই পারছেন কলহসৃষ্টিকারীর মস্তকটি এখনো গড়গড় করে আবোল-তাবোল গালগল্প বলে অন্যের ক্ষতির চেষ্টা রেখেছে অবিরত! নারিকেল গাছকে বার্মা ভাষায় ‘গন পিন’ বা কলহ সৃষ্টিকারী গাছ বলে। কালে কালে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘অহন পিন’ রূপ নিয়েছে।

৩.
নাগিন, সূর্য আর সাদা কাকের গল্প
বার্মার উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এক সরোবরের গভীর জলে বাস করতো এক নাগিন রাজকন্যা। সরোবরের কাছাকাছি লোকালয়ের বাসিন্দারা প্রায়ই নাগিনকন্যার রুপালি ঝলক সূর্যালোকে দেখতে পেত।
যায় দিন জলাবাসে বড় হয় নাগিনকন্যা। সরোবরের জলে মনুষ্য প্রজাতির মীন শিকার আর স্নানক্রিয়ার দেখে সে আকৃষ্ট হতে থাকে। একসময় সান্নিধ্যের আশায় উঠে আসে ডাঙায় রমণীর অপরূপে। কিন্তু, সরোবরের পাড়ে একটা পাথরে বসেই লক্ষ করে মানুষের কার্যকলাপ আর জলকেলি; তাদের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হয় না তার।
ওদিকে সূর্যকুমার প্রতিদিনই নাগিনকন্যার রূপে মোহিত হোন। তাই ধরাতে ধরা দেন এক সুঠাম ব্যাধের বেশে। সূর্যকুমারের বাঁশের বাঁশির সুর-প্রেমজালে বাধা পড়ে নাগিন রাজকন্যাও। একে অপরকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। আর এতেই সূর্য ভুলে যায় নিজ অক্ষের চক্রযাত্রা পূর্ণ করতে। ধরাধামে দেখা দেয় অন্ধকার!
মনুষ্যকুল বেশ ক’দিন ধরেই লক্ষ করছিল সূর্যের কিছুটা পূর্বাহ্নেই অস্ত যাওয়া আর দেরিতে উদয় হওয়া। তাই তারা শুরু করে শোরগোল। ক্রমবর্ধমান মনুষ্য অসন্তোষের কারণে সূর্য বিদায় নেয়। যেতে যেতে প্রিয়া নাগিনকে বলে, ‘আমি কর্তব্যনিষ্ঠ, তাই চলিয়া যাইব। তবে আবার আসিব ফিরিয়া।’
অন্তঃসত্ত্বা নাগিনকন্যা স্ফীত উদরে সূর্যকুমারকে জড়িয়ে বললো, ‘জানি প্রিয়ে, তুমি কর্তব্যে ধাবিত হইবে, অবশ্যই তুমি যাইবে। তবে আমার যে দিন আর না কাটিবে!’
সূর্যকুমার চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার সঙ্গী এই ধবল কাক। আমাদের সন্তান হইবার খবর সেই যথাসময়ে আমাকে পৌঁছাইয়া দিবে।’
নাগিনকন্যা মানবীর বেশ ছেড়ে আবার স্বরূপে ফিরে যায় সরোবরের গহীনে। দিন যায়, মাস যায়।
প্রোষিতভর্তৃকা নাগিনী তিনটি ডিম দেয়। ধবল কাককে ডেকে বলে, ‘যাও আমার স্বামী তোমার প্রভু সূর্যকুমারকে যাইয়া কহ, তাহার তিনটি সন্তান জন্মিবে।’
‘আমি যাই, আমি যাই’ বলে সাদা কাক দেয় উড়াল।
সব জেনে গর্বিত সূর্যকুমার কাকের হাতে তুলে দেয় মহামূল্যবান চুনিপাথর। আর বলে, ‘যাও আমার প্রিয়তমাকে কহ সন্তানদিগের জন্য একটি রাজ্য ক্রয় করিতে; যাহাতে তাহারা রাজ্যশাসন করিতে পারে। ডিম হইতে বাহির হইবার পর যেন তাহাদের কোনো কিছুর অভাববোধ না হয়।’
‘আমি যাই, আমি যাই’ বলে সাদা কাক দেয় উড়াল।
সূর্যালয় থেকে মর্ত্যলোকে ওরকম একটি মহামূল্য ওজস্বী পাথরপূর্ণ রেশমের থলে বয়ে বেড়াতে কাকের কষ্টই হচ্ছিল। উপরন্তু, এতটা উড়ে আসতে লেগেছিল তীব্র ক্ষুধা। পাশের লোকালয়ে ভোজসভার সুগন্ধও প্রবেশ করছিল তার নাসারন্ধ্রে। কানে এলো সুরললিত গীতবাদ্য। ভাবলো এই ভারী থলেটা গাছের ডালে লুকিয়ে যাই না কিছুটা পেটপুজো করে আসি। যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ।
এপথেই যাচ্ছিল এক সওদাগর। ঘটনাটা তার দৃষ্টিগোচর হয়। সওদাগর জানতো এই কাক কোনো দেবাত্মার বার্তাবাহক। তাই দেরি না করে রেশমের থলেটি খুলে ফেললো। চুনিপাথর দেখে আনন্দে সে আত্মহারা; নিজের মুখ চেপে রেখে চিৎকারের শব্দ গোপন করলো। হাতের কাছে পাওয়া গোবর আর কাঠ-পাথর দিয়ে থলে পূর্ণ করে মহামূল্য চুনিপাথর নিয়ে দিল চম্পট!
যামিনী না যেতেই কাকের মনে হলো দায়িত্বের কথা। যথাসম্ভব দ্রুত উড়ে গিয়ে পৌঁছে দিল সূর্যকুমারের উপহার নাগিন রাজকন্যাকে। কিন্তু হায়! এহেন নির্মম উপহাসে নাগিনকন্যা ডিমগুলো সরোবরের পাড়ে রেখে নিদারুণ অভিমানে অন্তরীণ হলো অতল জলের গহীনে।
বিক্ষুব্ধ সূর্যকুমার ধবল কাককে শাস্তিস্বরূপ কালো বানিয়ে দিল। সেই থেকে সকল কাকই কালো!
অবহেলিত ডিমগুলো দেখে মায়া হলো মহামতি পর্বতাত্মার। তিনি নির্দেশ দিলেন বরফকে গলতে। সেই বরফ গলা পানিতে ডিমগুলো পড়লো বিখ্যাত ইরাবতী নদীর জলে।
প্রথম ডিমটি নিয়ে নেই কোনো বিতর্ক। জানা যায়, ডিমটি মোগক (মান্দালয় শহর থেকে ১৪৮ কিলোমিটার দূরে চুনিপাথরের খনি এলাকা) এসে ফেটে যায়। আর তার ভেতরে রক্ষিত সব চুনিপাথর মোগকে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় ডিমটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি মধ্য বার্মায় এসে ভেঙে যায়। আবার কারো কারো মতে, ডিম থেকে বের হয় এক অনিন্দ্যসুন্দরী রাজকুমারী, এখন হয়তো বাস করছে কোনো অজানা রাজ্যে!
তৃতীয় ডিমটিই বিতর্ক ছাড়া হবে কি করে! কেউ বলে, এটি গড়িয়ে গড়িয়ে একটা বড় কুমির জন্ম দেয়। অন্যরা মনে করেন, বার্মার পেগু সাম্রাজ্যের স্বাতি রাজকুমার ডিম থেকে আবির্ভূত হন আর বেড়ে ওঠেন কোনো এক নির্জনবাসী দেবীর লালিত্য-আদরে।

প্রকাশিত গল্প : সমকাল

লেখক : বদরুল হাসান, সমাজকর্মী

Tag :
রিপোর্টার সম্পর্কে

Sound Of Community

জনপ্রিয় সংবাদ

আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ

গল্প বার্মার লোককাহিনি- বদরুল হাসান

পোস্ট করা হয়েছে : ০১:৫৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল ২০২৩

বদরুল হাসান

বার্মায় বসবাসকালে (অক্টোবর ২০১৪-ডিসেম্বর ২০১৭) সেখানকার সমৃদ্ধ লোককাহিনির সাথে নানাভাবে পরিচিত হই। কখনোবা ইংরেজিতে লেখা বই ও ভ্রমণের সময় বিমানের সিটপকেটে রাখা ইন-ফ্লাইট ম্যাগাজিন পড়ে, কখনো তথ্যবাতায়ন ঘেঁটে, আবার কখনো লোকমুখে শুনে বেশ কিছু লোককাহিনি সংগ্রহ করেছিলাম। সেখান থেকে এই সাতটি গল্প পাঠকের জন্য পরিবেশন করা হলো।
প্রথম গল্প ‘একতাই বল’ একটি কাচিন লোককাহিনি। কাচিন মায়ানমারের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি স্টেট। গল্পটি এয়ার ক্যাম্বোজা বিমানে ভ্রমণের সময় সরবরাহ করা ইনফ্লাইট ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত। তিন ঘণ্টার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে উড়ে চলার সময় মোবাইল ফোনের নোটস অ্যাপে অনুবাদটি করা হয়েছিল। পরে আমার মেয়ে জোহারিন মুনাজ্জা দশ বছরে পা দেবার আগেই আলোহা নামের একটি গণিত শিক্ষাকেন্দ্রে যোগ দিয়েছিল শিক্ষক-সহযোগী হিসেবে। তার প্রথম মাসের বেতন পাওয়াকে উপলক্ষ করে গল্পটি তাকে উৎসর্গ করেছিলাম।
‘নারিকেল গাছের ইতিবৃত্ত’, ‘এক যে বোকা বালক’, ‘বাগানে এত বিপুল সংখ্যক প্যাগোডা কোথা থেকে এলো?’, ‘কাক কেন কোকিলছানা লালন করে? আর প্যাঁচাই বা কেন কেবল রাতবিরাতে বের হয়?’ গল্প চারটি মং টিন অং রচিত বার্মিজ ফোকটেলস গ্রন্থ অবলম্বনে অনূদিত। বাগান বিশ্বের অন্যতম প্রত্নতাত্বিক পর্যটন এলাকা। এখানে প্যাগোডার সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের অধিক। কিন্তু কেমন করে এত প্যাগোডা ওখানে তৈরি হয়েছিল এ নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে রয়েছে বিশদ আলোচনা। ‘বাগানে এতসংখ্যক প্যাগোডা কোথা থেকে এলো?’ গল্পটিতে সে রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি পোপা পর্বত আর বাগানের এক ভিক্ষু রসায়নবিদের পরশপাথর আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। এই গল্পটি নিয়ে বার্মিজ ভাষায় নাটক ও গীতিনাট্য উপস্থাপিতও হয়, যা বেশ জনপ্রিয়।
‘ইনলে হ্রদের অতিথির মাছ খাওয়া’ গল্পটি ইনলে হ্রদে ভ্রমণকালে আমাদের গাইড আর-কারের মুখ থেকে শোনা। ঐতিহাসিকভাবে বার্মায় দারিদ্র্য বিদ্যমান। বিশেষত জলাবদ্ধ, পাহাড়ি আর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় দারিদ্র্য ভীষণ প্রকট। শ্যান স্টেটে ১১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইনলে হ্রদের চারদিকে রয়েছে ৭০ হাজার মানুষের বসতি। হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বার্মার অনন্য পর্যটন। রয়েছে ভাসমান রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, প্যাগোডা এবং বাজার। হ্রদে ভাসমান এমনই একটি রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন ভোজনে মাছ খাওয়ার সময় আমাদের গাইড-বন্ধু আর-কার এই প্রচলিত গল্পটি বলেছিল। গল্পটি বলে সে যোগ করেছিল, ‘ধরে নিন এটি আমার জীবনেরই কাহিনি!’ দারিদ্র্য বার্মার সাধারণ জনসাধারণকে অতিথি বিমুখ করে তোলে নি। এটি ঠিক সেরকম একটি গল্প।
‘নাগিন, সূর্য আর সাদা কাকের গল্প’টি ক্যাথি এস মজলি (Cathy S Mosely)-এর ইংরেজি বর্ণনা থেকে বাংলায় রূপান্তরিত। এই গল্পে এক সময়ের সাদা কাক কী করে চিরতরে কালো হলো তাই বিধৃত হয়েছে।

১.
একতাই বল: কাচিন সংস্করণ
নদীর ধারে একটি ব্যাঙ বিষণ্ন মনে বসে ছিল। কোথা থেকে এক মতলববাজ বাঘ এসে হাজির। উদ্দেশ্য ব্যাঙের স্বাদ গ্রহণ করা আর কী! কিন্তু, এমনি এমনি ব্যাঙ ধরে খেয়ে ফেলায় আনন্দ নেই। বাঘ বলে কথা! সে ভাবলো একটু ব্যাঙকে খেলিয়ে নেয়া যাক। তারপর না হয় মজা করে খাবো।
বাঘ: কি হে ভায়া মন খারাপ নাকি?
বাঘকে দেখে ব্যাঙ ভয় লুকানো চেষ্টা করলো। নিজেকে আড়াল করতে না পেরে আমতা আমতা করে আলাপ শুরু করলো।
ব্যাঙ: না, না মন খারাপ হবে কেন! এমনি বসে আছি। ভাবছি নদীটা কি করে পার হব।
বাঘ: তুমি তো ঐ ছোটো পাহাড়টাতেই চরতে পারবে না আর এই বিশাল নদী পার হবে কি করে?
ব্যাঙ: এ আর এমনকি লাফিয়ে লাফিয়ে আমি সহজেই কত পাহাড়ে উঠে যাই।
বাঘ: তবে হয়ে যাক এক হাত, দেখি কে আগে ওই পাহাড়ে উঠতে পারে?
বাঘ দৌড় দিতেই ব্যাঙ এক লাফে তার লেজের শেষাংশ ধরে ঝুলে রইলো। আর পাহাড়ে বাঘ পা ফেলার আগেই টপ করে লাফিয়ে নেমে গেলো। দুষ্টবুদ্ধি বাঘ হেরে গিয়ে নতুন ফন্দি আঁটলো।
বাঘ: আচ্ছা, তুমি তো জিতে গেছো। তাহলে চলো দেখি আগে কে নদীটা পার হতে পারে? তুমি আগে পার হলে আমাকে খেয়ে ফেলবে; আর আমি জিতলে তোমাকে খাবো।
এতো মহাবিপদ দেখছি! ব্যাঙ একটু ভেবে নিল।
ব্যাঙ: ঠিক আছে তবে সাত দিন পরে। আর আমার একটা শর্ত আছে, নদী পার হবার সময় আমরা দুজনেই ডাকতে ডাকতে পার হবো।
বাঘ তাতেও রাজি। ভাবলো মন্দ কি সাত দিন পরেই না হয় ব্যাঙের মাংস খেলাম।
প্রাণে বাঁচতে মরিয়া ব্যাঙ বুদ্ধি আঁটলো। বন-জলের সব ব্যাঙকে ডেকে বসলো বৈঠকে। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে হলে একযোগে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো নদীর পানিতে এপার-ওপার কিছুদূর পরপর একেকটি ব্যাঙ ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকবে। প্রথম ব্যাঙের ডাক শোনার পর তারা একে একে ডেকে চলবে। বাঘ পৌঁছানোর আগেই শেষের ব্যাঙ ওপারে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে থাকবে ‘জিতে গেছি, জিতে গেছি।’
ঐক্যবদ্ধ ব্যাঙ দলের শক্তির কাছে বুদ্ধির জোরে শক্তিধর বাঘ হেরে গেলো। আর বিজয়ী ব্যাঙেরা সুযোগ পেলো একটা বাঘ খেয়ে ফেলার।

২.
নারিকেল গাছের ইতিবৃত্ত
অনেক অনেক দিন আগের কথা। বার্মায় একবার তিনজন লোক ভেলায় চরে উপকূলে এসে নামলো। এদের একজন ছিল চোর, আরেকজন ডাইনি, আর শেষজন অনর্থক কলহ সৃষ্টিকারী। অপরাধের শাস্তি হিসেবে নিজ দেশের রাজা তাদের ভেলায় ভাসিয়ে বিতারিত করেছে।
উপকূলে ইতস্তত এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে তিনজনকে বার্মা রাজার লোকেরা ধরে রাজদরবারে হাজির। অকপটে রাজা ও সভাসদকে তারা নিজেদের অপকর্মের শাস্তির কথা জানিয়ে দিল। সব জেনেশুনে রাজা চোর এবং ডাইনি এই দুজনের প্রত্যেককে দিলেন এক সহস্র রৌপ্যমুদ্রা আর একটি করে বসত বাড়ি। আর কলহ সৃষ্টিকারীকে দিলেন মৃত্যুদণ্ড। রাজার সভাসদ এমন সিদ্ধান্তের কারণ কি জানতে চাইলেন। রাজা জানালেন, দারিদ্র্যের শিকার হয়ে চোর চুরি করতো। এখন তার দারিদ্র্য থাকবে না তাই সে আর চুরিও করবে না। আর ডাইনি কেবল অপরের সম্পদ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ভয় দেখালেও কারো ক্ষতি করতো না। সেও তো দরিদ্র। এখন তো তার দারিদ্র্য থাকবে না, তাই সে আর কাউকে ভয়ও দেখাবে না। কিন্তু, এই কলহসৃষ্টিকারী অকারণে মানুষের মধ্যে বিবাদ-ফ্যাসাদ লাগায়। ও তো ভালো হবার নয়, তাই মৃত্যুদণ্ডই ওর প্রাপ্য। জল্লাদের খড়গে যথারীতি কলহসৃষ্টিকর্তার ধর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূমিতে পতিত রইলো।
পরদিন একই পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাজার এক অমাত্য। পরে থাকা মৃত মস্তক তাকে দেখে কথা বলে উঠলো। সে বললো, ‘এই তোর রাজাকে গিয়ে বল এখানে এসে আমার কাছে হাত জোড় করে মাথা নত করতে। নইলে আমি ওর ধর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করবো।’ অমাত্য ত্রস্তপদে প্রাসাদে পৌঁছে রাজা ও সভাসদকে ঘটনাটি জানালো। কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করলো না। রাজা ভাবলো তাকে নিয়ে মজা করতে এই কল্পকাহিনি। লোকটি তখন নিরুপায় হয়ে তার সঙ্গে কাউকে পাঠানোর অনুরোধ জানালো। অতঃপর, একজন কর্তাকে সাথে নিয়ে অমাত্য পরে থাকা মস্তকটির দেখতে গেল। কিন্তু, একি! এ মস্তক তো কোনো কথাই বলছে না আর! নাখোশ রাজা অমাত্যের মস্তক কর্তনের আদেশ দিলেন। জল্লাদ ওই কর্তাব্যক্তির সামনেই অমাত্যের শিরোচ্ছেদ করলো ঠিক একই বধ্যভূমিতে।
কিন্তু হায়, আবার সেই দুরাত্মার দেহবিহীন মাথা কথা বলতে শুরু করেছে। এবার সে অট্টহাস্যে বলছে, ‘হা হা হা! আমার দেহে প্রাণ নেই তো কি হয়েছে, এখনো আজেবাজে গালগল্প বানিয়ে বলে অনিষ্ঠ করতে আমি যথেষ্ট পারঙ্গম!’ এই কর্তা বুঝতে পারলেন কি অবিচারই না অমাত্যের প্রতি করা হয়েছে। তৎক্ষণাত তিনি রাজাকে সবিস্তারে বিষয়টি জানালেন।
রাজা বুঝতে পারলো এই ছিন্নমস্তক না জানি আরো কত কি অনিষ্ঠ করে ফেলে! তাই তার আদেশে মাথাটি মাটিতে পুতে ফেলা হলো। পরদিন, মস্তক পোতা জায়গায় একটি আজব গাছ জন্মালো, যার ফল দেখতে অবিকল ওই কলহ সৃষ্টিকর্তার মস্তকের অনুরূপ!
সেই থেকে আপনি কোনো নারিকেল কানের কাছে নিয়ে নাড়ালে ভিতরের গড়গড় শব্দ শুনতে পাবেন। বুঝতেই পারছেন কলহসৃষ্টিকারীর মস্তকটি এখনো গড়গড় করে আবোল-তাবোল গালগল্প বলে অন্যের ক্ষতির চেষ্টা রেখেছে অবিরত! নারিকেল গাছকে বার্মা ভাষায় ‘গন পিন’ বা কলহ সৃষ্টিকারী গাছ বলে। কালে কালে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘অহন পিন’ রূপ নিয়েছে।

৩.
নাগিন, সূর্য আর সাদা কাকের গল্প
বার্মার উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এক সরোবরের গভীর জলে বাস করতো এক নাগিন রাজকন্যা। সরোবরের কাছাকাছি লোকালয়ের বাসিন্দারা প্রায়ই নাগিনকন্যার রুপালি ঝলক সূর্যালোকে দেখতে পেত।
যায় দিন জলাবাসে বড় হয় নাগিনকন্যা। সরোবরের জলে মনুষ্য প্রজাতির মীন শিকার আর স্নানক্রিয়ার দেখে সে আকৃষ্ট হতে থাকে। একসময় সান্নিধ্যের আশায় উঠে আসে ডাঙায় রমণীর অপরূপে। কিন্তু, সরোবরের পাড়ে একটা পাথরে বসেই লক্ষ করে মানুষের কার্যকলাপ আর জলকেলি; তাদের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হয় না তার।
ওদিকে সূর্যকুমার প্রতিদিনই নাগিনকন্যার রূপে মোহিত হোন। তাই ধরাতে ধরা দেন এক সুঠাম ব্যাধের বেশে। সূর্যকুমারের বাঁশের বাঁশির সুর-প্রেমজালে বাধা পড়ে নাগিন রাজকন্যাও। একে অপরকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। আর এতেই সূর্য ভুলে যায় নিজ অক্ষের চক্রযাত্রা পূর্ণ করতে। ধরাধামে দেখা দেয় অন্ধকার!
মনুষ্যকুল বেশ ক’দিন ধরেই লক্ষ করছিল সূর্যের কিছুটা পূর্বাহ্নেই অস্ত যাওয়া আর দেরিতে উদয় হওয়া। তাই তারা শুরু করে শোরগোল। ক্রমবর্ধমান মনুষ্য অসন্তোষের কারণে সূর্য বিদায় নেয়। যেতে যেতে প্রিয়া নাগিনকে বলে, ‘আমি কর্তব্যনিষ্ঠ, তাই চলিয়া যাইব। তবে আবার আসিব ফিরিয়া।’
অন্তঃসত্ত্বা নাগিনকন্যা স্ফীত উদরে সূর্যকুমারকে জড়িয়ে বললো, ‘জানি প্রিয়ে, তুমি কর্তব্যে ধাবিত হইবে, অবশ্যই তুমি যাইবে। তবে আমার যে দিন আর না কাটিবে!’
সূর্যকুমার চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার সঙ্গী এই ধবল কাক। আমাদের সন্তান হইবার খবর সেই যথাসময়ে আমাকে পৌঁছাইয়া দিবে।’
নাগিনকন্যা মানবীর বেশ ছেড়ে আবার স্বরূপে ফিরে যায় সরোবরের গহীনে। দিন যায়, মাস যায়।
প্রোষিতভর্তৃকা নাগিনী তিনটি ডিম দেয়। ধবল কাককে ডেকে বলে, ‘যাও আমার স্বামী তোমার প্রভু সূর্যকুমারকে যাইয়া কহ, তাহার তিনটি সন্তান জন্মিবে।’
‘আমি যাই, আমি যাই’ বলে সাদা কাক দেয় উড়াল।
সব জেনে গর্বিত সূর্যকুমার কাকের হাতে তুলে দেয় মহামূল্যবান চুনিপাথর। আর বলে, ‘যাও আমার প্রিয়তমাকে কহ সন্তানদিগের জন্য একটি রাজ্য ক্রয় করিতে; যাহাতে তাহারা রাজ্যশাসন করিতে পারে। ডিম হইতে বাহির হইবার পর যেন তাহাদের কোনো কিছুর অভাববোধ না হয়।’
‘আমি যাই, আমি যাই’ বলে সাদা কাক দেয় উড়াল।
সূর্যালয় থেকে মর্ত্যলোকে ওরকম একটি মহামূল্য ওজস্বী পাথরপূর্ণ রেশমের থলে বয়ে বেড়াতে কাকের কষ্টই হচ্ছিল। উপরন্তু, এতটা উড়ে আসতে লেগেছিল তীব্র ক্ষুধা। পাশের লোকালয়ে ভোজসভার সুগন্ধও প্রবেশ করছিল তার নাসারন্ধ্রে। কানে এলো সুরললিত গীতবাদ্য। ভাবলো এই ভারী থলেটা গাছের ডালে লুকিয়ে যাই না কিছুটা পেটপুজো করে আসি। যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ।
এপথেই যাচ্ছিল এক সওদাগর। ঘটনাটা তার দৃষ্টিগোচর হয়। সওদাগর জানতো এই কাক কোনো দেবাত্মার বার্তাবাহক। তাই দেরি না করে রেশমের থলেটি খুলে ফেললো। চুনিপাথর দেখে আনন্দে সে আত্মহারা; নিজের মুখ চেপে রেখে চিৎকারের শব্দ গোপন করলো। হাতের কাছে পাওয়া গোবর আর কাঠ-পাথর দিয়ে থলে পূর্ণ করে মহামূল্য চুনিপাথর নিয়ে দিল চম্পট!
যামিনী না যেতেই কাকের মনে হলো দায়িত্বের কথা। যথাসম্ভব দ্রুত উড়ে গিয়ে পৌঁছে দিল সূর্যকুমারের উপহার নাগিন রাজকন্যাকে। কিন্তু হায়! এহেন নির্মম উপহাসে নাগিনকন্যা ডিমগুলো সরোবরের পাড়ে রেখে নিদারুণ অভিমানে অন্তরীণ হলো অতল জলের গহীনে।
বিক্ষুব্ধ সূর্যকুমার ধবল কাককে শাস্তিস্বরূপ কালো বানিয়ে দিল। সেই থেকে সকল কাকই কালো!
অবহেলিত ডিমগুলো দেখে মায়া হলো মহামতি পর্বতাত্মার। তিনি নির্দেশ দিলেন বরফকে গলতে। সেই বরফ গলা পানিতে ডিমগুলো পড়লো বিখ্যাত ইরাবতী নদীর জলে।
প্রথম ডিমটি নিয়ে নেই কোনো বিতর্ক। জানা যায়, ডিমটি মোগক (মান্দালয় শহর থেকে ১৪৮ কিলোমিটার দূরে চুনিপাথরের খনি এলাকা) এসে ফেটে যায়। আর তার ভেতরে রক্ষিত সব চুনিপাথর মোগকে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় ডিমটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি মধ্য বার্মায় এসে ভেঙে যায়। আবার কারো কারো মতে, ডিম থেকে বের হয় এক অনিন্দ্যসুন্দরী রাজকুমারী, এখন হয়তো বাস করছে কোনো অজানা রাজ্যে!
তৃতীয় ডিমটিই বিতর্ক ছাড়া হবে কি করে! কেউ বলে, এটি গড়িয়ে গড়িয়ে একটা বড় কুমির জন্ম দেয়। অন্যরা মনে করেন, বার্মার পেগু সাম্রাজ্যের স্বাতি রাজকুমার ডিম থেকে আবির্ভূত হন আর বেড়ে ওঠেন কোনো এক নির্জনবাসী দেবীর লালিত্য-আদরে।

প্রকাশিত গল্প : সমকাল

লেখক : বদরুল হাসান, সমাজকর্মী