ঢাকা ০৮:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ নয়নতারা মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত শ্যামনগরে হরিণের মাংস সহ আটক দুই সাতক্ষীরা সাস্থ্য উন্নয়ন কমিটির বর্ধিত সভায় ২৬ অক্টোবর খুলনা রোড মোড় মানব বন্ধনের সিদ্ধান্ত খুলনা প্রেসক্লাবে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি উপ-পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান অনুষ্ঠিত  কালিগঞ্জে তরুন দলের কমিটি গঠন সভাপতি সুলতান,সম্পাদক আলতাপ পানি নিষ্কাশনে ইউএনও,র প্রাণপণ চেষ্টা অব্যহত তালার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন আবারও পানিবন্ধী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সঃ কে কটুক্তির প্রতিবাদে রূপসা বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ

  • Sound Of Community
  • পোস্ট করা হয়েছে : ০৬:৪১:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩
  • ৭৫ জন পড়েছেন ।

জার্মানির মারবুর্গে একবার রবীন্দ্রনাথের ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ভাষণ শেষে যান কবির ঘরে। মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘গুরুদেব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু হাসিমুখে বসতে বললেন। তারপর ভালো করে তাকিয়ে বললেন, এত রোগা হয়ে গিয়েছিস কেন?’
আমি মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলুম।
কিছু কথাবার্তা হল। আমার লেখাপড়া সম্বন্ধে। যখন উঠলুম তখন বললেন, ‘অমিয়কে ডেকে দে তো।’
চক্রবর্তী এলেন। গুরুদেব বললেন, ‘অমিয়, একে ভালো করে খাইয়ে দাও।’

মুজতবা আলীর পরবর্তী লাইনগুলো এ রকম।

‘জানি পাঠকমণ্ডলী এই তামসিক পরিসমাপ্তিতে ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু সোক্রাতেসের চোখে যখন মরণের ছায়া ঘনিয়ে এল, আর শিষ্যরা কানের কাছে চিৎকার করে শুধালেন, গুরুদেব কোনও শেষ আদেশ আছে?’
তখন সোক্রাতেস বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। পরশুদিন যে মুর্গিটা খেয়েছিলুম, তার দাম দেওয়া হয়নি। দিয়ে দিয়ো। এই সোক্রাতেসের শেষ কথা।’

সব দিকে যাঁর দৃষ্টি তিনিই তো প্রকৃত গুরু এবং তাও মৃত্যুর বহু পূর্বে।
মুজতবা আলী বোঝাতে চেয়েছিলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বা সোক্রাতেস। একজন অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে ক্লান্তিকর অনুষ্ঠানের পরেও ভুলে যাননি, পুত্রসম কেউ না খেয়ে রয়েছেন। অন্যজন মৃত্যুর মুহূর্তেও ভুলে যাননি, তাঁর ঋণ কত। ভুলে যাননি সাধারণ মুর্গিওয়ালাকেও।

আজকের পৃথিবীতে চারদিকে তাকালে প্রশ্ন জাগে, এরকম সর্বজনগ্রাহ্য আন্তরিক, উদারতাময় গুরু কি আর কোথাও রয়েছেন? যাঁরা আকাশের মতো অন্তহীন উদার হয়ে সহজসরল থেকে যেতে পারেন আজীবন?
চারদিকে তাকাই। কোথাও তেমন মুখ নেই। উদারতাও নেই। শুধু অতিসাম্প্রতিক সময়ের কথা বলছি না। এই শতাব্দীতেই কেউ এখনও এলেন না, যাঁর দিকে তাকালে আবেগতাড়িত হয় গোটা বিশ্ব। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানে প্রতি বছরই নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন কেউ না কেউ। কেউ বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারেননি। ইদানীং পৃথিবীজুড়ে রাজনীতিকরা অতি জনপ্রিয়। কিন্তু সে অর্থে সব দেশে মন কাড়ার কিছু করতে পারেননি। অতীতে যেমন আদর্শ হয়ে উঠেছেন মহাত্মা গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং, চে গেভারা, থিওডোর রুজভেল্ট, মাও সে তুং, নেলসন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলাই সেই অর্থে শেষ সর্বজনীন, বিশ্বজনীন গুরু। বামপন্থীরা বলতে পারেন নোয়ান চমস্কির কথা, অমর্ত্য সেনের কথা। চিন বিরোধীরা বলবেন দলাই লামার কথা। আসল সত্যি হল, তাঁরা একটা অংশের প্রেরণা হতে পারেন, পুরো অংশের নন। উদারতাহীন হয়ে উঠছে এই জগৎ। রাহুল গান্ধির সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া যার শেষতম উদাহরণ।

গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানব কে? অনেক সমীক্ষাশেষে টাইম পত্রিকায় ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংখ্যায় ঘোষণা হয়েছিল, বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনই শতাব্দীর সেরা। রানার্স হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি এবং ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট। বিবিসি আবার শতাব্দীর সেরা বাছতে গিয়ে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করেছিল। অ্যাক্টিভিস্ট বিভাগে এক নম্বর স্বীকৃতি পান মার্টিন লুথার কিং। গান্ধিজি, হেলেন কেলারকে হারিয়ে নেতা বিভাগে শতাব্দীর সেরা হন নেলসন ম্যান্ডেলা। বিনোদনে ডেভিড বোওয়ি। চার্লি চ্যাপলিন, মেরিলিন মনরো, বিলি হলিডেদের হারিয়ে। খেলায় শতাব্দীর সেরা মহম্মদ আলি। পেলে, বিলি জিন কিং ছিলেন পরে। এই সব নাম টাইপ করতে গিয়ে আচ্ছন্ন করে অন্যরকম ঘোর। ধূসর হয় প্রতিক্রিয়া। মাথায় ঘোরে, এই শতাব্দীর প্রায় এক চতুর্থাংশ চলে যাচ্ছে, খেলা বা বিনোদনে হয়তো শতাব্দীর সেরা দাবিদারদের দেখছি; রাজনীতি বা অ্যাক্টিভিজমে কি তেমন লোক রয়েছেন আদৌ? উদার এবং সংবেদনশীল?

এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনও দেশেই এমন রাষ্ট্রনায়ক নেই, যাঁর উদারতায় কুর্নিশ করার ইচ্ছে জাগে। গান্ধি সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, উনিই ছিলেন আমার রাজনৈতিক গুরু, রোল মডেল। আজ কি তেমন নেতা পৃথিবী পাবে? পুতিন, শি জিনপিং, নেতানিয়াহু, এর্দোগান, কিম জংদেরই সেখানে রাজত্ব। এঁরা সবাই প্রতিহিংসাপরায়ণতার নাম।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের শেষ তিরিশ বছরের তালিকায় চোখ রাখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে আরও। এই সময়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মিখাইল গর্বাচভ, ইতঝাক রবিন, সাইমন পেরেস, ইয়াসের আরাফত, হেনরি কিসিংগার, লে ডাক থো, জিমি কার্টার, আল গোর, বারাক ওবামা, আবি আমেদ আলির মতো বিতর্কিত চরিত্র। যাঁদের জীবনে অনেকরকম রং। এমনকি কাউকে না পেয়ে একবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেও দিয়ে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। গত দুবছরে রাশিয়া, বেলারুশ, ফিলিপিন্সের যাঁদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল, তাঁদের কি চেনে সারা বিশ্ব?

ভাবতে অবাক লাগে, এই নোবেল শান্তি পুরস্কারই মহাত্মা গান্ধি পাননি পাঁচবার মনোনীত হয়ে। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮- যে পাঁচটা বছর প্রত্যাখ্যাত গান্ধি হয়েছিলেন, সে বছরগুলোয় কারা পুরস্কার পেয়েছিলেন, নাম লেখা যাক। ইংল্যান্ডের ভিসকাউন্ট সিসিল অফ চেলউড, নানসেন ইন্টারন্যাশনাল অফিস ফর রিফিউজিস, দ্য কোয়াকার্স। তাঁদের কি মনে রেখেছে বিশ্ব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৩৯ সালে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। ১৯৪৮ সালে বলা হয়, কোনও আদর্শ জীবন্ত মানুষ নেই বলে দেওয়া হচ্ছে না। গান্ধি সেবারই নিহত হন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর কথায় রয়েছে, অন্তিম মুহূর্তেও আদর্শ উদার গুরুদের নজর থাকবে সব দিকে। পড়ে ভাবি, দেখি তো হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ে বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘গুরু’ শব্দটির অর্থ কত রকম! সেখানে সবিস্ময় তাকিয়ে থাকতে হয় বিশাল পাতা জুড়ে গুরুর অসংখ্য অর্থ দেখে। গুরুর মানেই ২৭ রকম। তারপর আবার শুধু পুরুষ অর্থে ২২ রকম মানে। এখানেই শেষ নয় অবশ্য। গুরুগতি, গুরুকার্য, গুরুবার, গুরুদক্ষিণা সহ আরও অন্তত তিরিশ শব্দের অর্থের ব্যাখ্যা।

গুরু শব্দের ব্যাখ্যা যেমন অনেক, তেমনই ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ শব্দটার ব্যাপ্তি বিশাল। দ্বিতীয়টা এখন পশ্চিমী বিশ্ব বসাচ্ছে গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার এবং হেলেন কেলারের নামের আগে। অ্যাক্টিভিস্ট কথার বাংলা মানে খুব কাছাকাছি দাঁড়ায় সমাজসেবী বা সমাজকর্মী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। সব সময় ব্যাপারটা মেলেও না অবশ্য। গান্ধিও অ্যাক্টিভিস্ট, আবার পাড়ার রাজনৈতিক দাদারাও অ্যাক্টিভিস্ট- এ আবার হয় নাকি? আরও বিভ্রান্তি, কেউ কেউ শব্দটা জঙ্গিদের সামনেও বসাচ্ছে সমান স্বচ্ছন্দে। অ্যাক্টিভিস্ট এবং নেতার ফারাক তৈরি করে দেওয়ার পশ্চিমী ঘরানা একদিকে ভালো। অ্যাক্টিভিস্টদের পুরোপুরি অরাজনৈতিক ভাবা হচ্ছে, বসানো হচ্ছে একটু বেশি উচ্চতায়।

গুরুর মানেও এভাবে পালটায়। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, লাইকের সংখ্যা দিয়ে সব কিছু বিচার হয় যেখানে, সেখানে যে কেউ যখন-তখন গুরু হয়ে যেতে পারেন। সাতদিন আগেই নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার অ্যাসলে তোজে ভারত সফরে এসেছিলেন। একদিন তাঁর এক সাক্ষাৎকার ভাইরাল। যেখানে তিনি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। কয়েক ঘণ্টা এ খবর নিয়ে অনিবার্য লেখালেখি হল। কিছুক্ষণ পরে বিব্রত তোজে নিজেই বিবৃতি দিলেন, আমি এ কথা বলিইনি। বোঝা গেল, ভারতই আপাতত ফেক নিউজের রাজধানী।

তাতে কী-ই বা আসে? মোদি-শিষ্যরা যে কাজটা চাইছিলেন, তা ততক্ষণে সারা-দুনিয়াময় প্রচার। আজও নেট খুললেই দেখবেন, মোদির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিতে সওয়াল শুরু হয়েছে কীভাবে। বিভিন্ন সাইটে, বিভিন্ন স্টাইলে। অস্ত্র তোজের সেই ফেক কোট। ভারত বা প্রতিবেশী দেশে অধিকাংশ রাজনীতিকের অনুরাগীদেরই এমন অস্ত্র।

দেখেশুনে সেই পুরোনো আক্ষেপ ঘিরে ধরে আবার। খেলা-বিনোদনের বিশ্বে গত তিরিশ বছরে বহু বর্ণময় চরিত্র এসেছে অনুকরণ করার মতো। শুধু আদর্শ রাষ্ট্রনায়কদের তালিকায় খরা-ই। পৃথিবীকে পথ দেখানোর গুরুর সত্যিই অভাব। গান্ধি এবং ম্যান্ডেলার নামে ভারতে ফাউন্ডেশন হয় গান্ধির ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। ভাবা হচ্ছিল, নোবেল শান্তি ও সিওল শান্তি পুরস্কারের ঢংয়ে প্রতিবার সেরা চরিত্রকে বাছবে ফাউন্ডেশন। প্রথমবার ২০১৯ সালে নাম বাছতেই হিমসিম ফাউন্ডেশনের কর্তারা। মনোনয়নের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, চরিত্রের আকাল কী পর্যায়ে লালকৃষ্ণ আদবানি, কেনেথ কাউন্ডা, বহু আগে প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমান, ডন স্টিফেন সেনানায়েকের সঙ্গে সেখানে ছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়গপ্রসাদ অলি, বুরুন্ডির ফার্স্ট লেডি ডেনিস বুকুমি, টোগোর প্রধানমন্ত্রী কোমি সেলম ক্লাসু। এমনকি আমিরশাহি সরকারও। শেষমেশ পুরস্কার পান দলাই লামা। তারপর ওই পুরস্কারের উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। সম্ভবত চরিত্রের আকাল দেখেই।

পথ দেখানোর মতো চরিত্র, আদর্শ হয়ে ওঠা উদার গুরুরা আজ কোথায়, এই আর্ত চিৎকার ধ্বনিত এখন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরে। সাহারা থেকে অ্যামাজন, সুমেরু থেকে সাইবেরিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হিমালয়ে পথে পথে।

– রূপায়ণ ভট্টাচার্য

বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন  ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

Tag :
রিপোর্টার সম্পর্কে

Sound Of Community

জনপ্রিয় সংবাদ

আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ

পোস্ট করা হয়েছে : ০৬:৪১:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩

জার্মানির মারবুর্গে একবার রবীন্দ্রনাথের ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ভাষণ শেষে যান কবির ঘরে। মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘গুরুদেব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু হাসিমুখে বসতে বললেন। তারপর ভালো করে তাকিয়ে বললেন, এত রোগা হয়ে গিয়েছিস কেন?’
আমি মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলুম।
কিছু কথাবার্তা হল। আমার লেখাপড়া সম্বন্ধে। যখন উঠলুম তখন বললেন, ‘অমিয়কে ডেকে দে তো।’
চক্রবর্তী এলেন। গুরুদেব বললেন, ‘অমিয়, একে ভালো করে খাইয়ে দাও।’

মুজতবা আলীর পরবর্তী লাইনগুলো এ রকম।

‘জানি পাঠকমণ্ডলী এই তামসিক পরিসমাপ্তিতে ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু সোক্রাতেসের চোখে যখন মরণের ছায়া ঘনিয়ে এল, আর শিষ্যরা কানের কাছে চিৎকার করে শুধালেন, গুরুদেব কোনও শেষ আদেশ আছে?’
তখন সোক্রাতেস বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। পরশুদিন যে মুর্গিটা খেয়েছিলুম, তার দাম দেওয়া হয়নি। দিয়ে দিয়ো। এই সোক্রাতেসের শেষ কথা।’

সব দিকে যাঁর দৃষ্টি তিনিই তো প্রকৃত গুরু এবং তাও মৃত্যুর বহু পূর্বে।
মুজতবা আলী বোঝাতে চেয়েছিলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বা সোক্রাতেস। একজন অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে ক্লান্তিকর অনুষ্ঠানের পরেও ভুলে যাননি, পুত্রসম কেউ না খেয়ে রয়েছেন। অন্যজন মৃত্যুর মুহূর্তেও ভুলে যাননি, তাঁর ঋণ কত। ভুলে যাননি সাধারণ মুর্গিওয়ালাকেও।

আজকের পৃথিবীতে চারদিকে তাকালে প্রশ্ন জাগে, এরকম সর্বজনগ্রাহ্য আন্তরিক, উদারতাময় গুরু কি আর কোথাও রয়েছেন? যাঁরা আকাশের মতো অন্তহীন উদার হয়ে সহজসরল থেকে যেতে পারেন আজীবন?
চারদিকে তাকাই। কোথাও তেমন মুখ নেই। উদারতাও নেই। শুধু অতিসাম্প্রতিক সময়ের কথা বলছি না। এই শতাব্দীতেই কেউ এখনও এলেন না, যাঁর দিকে তাকালে আবেগতাড়িত হয় গোটা বিশ্ব। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানে প্রতি বছরই নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন কেউ না কেউ। কেউ বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারেননি। ইদানীং পৃথিবীজুড়ে রাজনীতিকরা অতি জনপ্রিয়। কিন্তু সে অর্থে সব দেশে মন কাড়ার কিছু করতে পারেননি। অতীতে যেমন আদর্শ হয়ে উঠেছেন মহাত্মা গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং, চে গেভারা, থিওডোর রুজভেল্ট, মাও সে তুং, নেলসন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলাই সেই অর্থে শেষ সর্বজনীন, বিশ্বজনীন গুরু। বামপন্থীরা বলতে পারেন নোয়ান চমস্কির কথা, অমর্ত্য সেনের কথা। চিন বিরোধীরা বলবেন দলাই লামার কথা। আসল সত্যি হল, তাঁরা একটা অংশের প্রেরণা হতে পারেন, পুরো অংশের নন। উদারতাহীন হয়ে উঠছে এই জগৎ। রাহুল গান্ধির সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া যার শেষতম উদাহরণ।

গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানব কে? অনেক সমীক্ষাশেষে টাইম পত্রিকায় ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংখ্যায় ঘোষণা হয়েছিল, বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনই শতাব্দীর সেরা। রানার্স হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি এবং ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট। বিবিসি আবার শতাব্দীর সেরা বাছতে গিয়ে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করেছিল। অ্যাক্টিভিস্ট বিভাগে এক নম্বর স্বীকৃতি পান মার্টিন লুথার কিং। গান্ধিজি, হেলেন কেলারকে হারিয়ে নেতা বিভাগে শতাব্দীর সেরা হন নেলসন ম্যান্ডেলা। বিনোদনে ডেভিড বোওয়ি। চার্লি চ্যাপলিন, মেরিলিন মনরো, বিলি হলিডেদের হারিয়ে। খেলায় শতাব্দীর সেরা মহম্মদ আলি। পেলে, বিলি জিন কিং ছিলেন পরে। এই সব নাম টাইপ করতে গিয়ে আচ্ছন্ন করে অন্যরকম ঘোর। ধূসর হয় প্রতিক্রিয়া। মাথায় ঘোরে, এই শতাব্দীর প্রায় এক চতুর্থাংশ চলে যাচ্ছে, খেলা বা বিনোদনে হয়তো শতাব্দীর সেরা দাবিদারদের দেখছি; রাজনীতি বা অ্যাক্টিভিজমে কি তেমন লোক রয়েছেন আদৌ? উদার এবং সংবেদনশীল?

এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনও দেশেই এমন রাষ্ট্রনায়ক নেই, যাঁর উদারতায় কুর্নিশ করার ইচ্ছে জাগে। গান্ধি সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, উনিই ছিলেন আমার রাজনৈতিক গুরু, রোল মডেল। আজ কি তেমন নেতা পৃথিবী পাবে? পুতিন, শি জিনপিং, নেতানিয়াহু, এর্দোগান, কিম জংদেরই সেখানে রাজত্ব। এঁরা সবাই প্রতিহিংসাপরায়ণতার নাম।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের শেষ তিরিশ বছরের তালিকায় চোখ রাখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে আরও। এই সময়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মিখাইল গর্বাচভ, ইতঝাক রবিন, সাইমন পেরেস, ইয়াসের আরাফত, হেনরি কিসিংগার, লে ডাক থো, জিমি কার্টার, আল গোর, বারাক ওবামা, আবি আমেদ আলির মতো বিতর্কিত চরিত্র। যাঁদের জীবনে অনেকরকম রং। এমনকি কাউকে না পেয়ে একবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেও দিয়ে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। গত দুবছরে রাশিয়া, বেলারুশ, ফিলিপিন্সের যাঁদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল, তাঁদের কি চেনে সারা বিশ্ব?

ভাবতে অবাক লাগে, এই নোবেল শান্তি পুরস্কারই মহাত্মা গান্ধি পাননি পাঁচবার মনোনীত হয়ে। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮- যে পাঁচটা বছর প্রত্যাখ্যাত গান্ধি হয়েছিলেন, সে বছরগুলোয় কারা পুরস্কার পেয়েছিলেন, নাম লেখা যাক। ইংল্যান্ডের ভিসকাউন্ট সিসিল অফ চেলউড, নানসেন ইন্টারন্যাশনাল অফিস ফর রিফিউজিস, দ্য কোয়াকার্স। তাঁদের কি মনে রেখেছে বিশ্ব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৩৯ সালে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। ১৯৪৮ সালে বলা হয়, কোনও আদর্শ জীবন্ত মানুষ নেই বলে দেওয়া হচ্ছে না। গান্ধি সেবারই নিহত হন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর কথায় রয়েছে, অন্তিম মুহূর্তেও আদর্শ উদার গুরুদের নজর থাকবে সব দিকে। পড়ে ভাবি, দেখি তো হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ে বঙ্গীয় শব্দকোষে ‘গুরু’ শব্দটির অর্থ কত রকম! সেখানে সবিস্ময় তাকিয়ে থাকতে হয় বিশাল পাতা জুড়ে গুরুর অসংখ্য অর্থ দেখে। গুরুর মানেই ২৭ রকম। তারপর আবার শুধু পুরুষ অর্থে ২২ রকম মানে। এখানেই শেষ নয় অবশ্য। গুরুগতি, গুরুকার্য, গুরুবার, গুরুদক্ষিণা সহ আরও অন্তত তিরিশ শব্দের অর্থের ব্যাখ্যা।

গুরু শব্দের ব্যাখ্যা যেমন অনেক, তেমনই ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ শব্দটার ব্যাপ্তি বিশাল। দ্বিতীয়টা এখন পশ্চিমী বিশ্ব বসাচ্ছে গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার এবং হেলেন কেলারের নামের আগে। অ্যাক্টিভিস্ট কথার বাংলা মানে খুব কাছাকাছি দাঁড়ায় সমাজসেবী বা সমাজকর্মী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। সব সময় ব্যাপারটা মেলেও না অবশ্য। গান্ধিও অ্যাক্টিভিস্ট, আবার পাড়ার রাজনৈতিক দাদারাও অ্যাক্টিভিস্ট- এ আবার হয় নাকি? আরও বিভ্রান্তি, কেউ কেউ শব্দটা জঙ্গিদের সামনেও বসাচ্ছে সমান স্বচ্ছন্দে। অ্যাক্টিভিস্ট এবং নেতার ফারাক তৈরি করে দেওয়ার পশ্চিমী ঘরানা একদিকে ভালো। অ্যাক্টিভিস্টদের পুরোপুরি অরাজনৈতিক ভাবা হচ্ছে, বসানো হচ্ছে একটু বেশি উচ্চতায়।

গুরুর মানেও এভাবে পালটায়। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, লাইকের সংখ্যা দিয়ে সব কিছু বিচার হয় যেখানে, সেখানে যে কেউ যখন-তখন গুরু হয়ে যেতে পারেন। সাতদিন আগেই নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার অ্যাসলে তোজে ভারত সফরে এসেছিলেন। একদিন তাঁর এক সাক্ষাৎকার ভাইরাল। যেখানে তিনি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। কয়েক ঘণ্টা এ খবর নিয়ে অনিবার্য লেখালেখি হল। কিছুক্ষণ পরে বিব্রত তোজে নিজেই বিবৃতি দিলেন, আমি এ কথা বলিইনি। বোঝা গেল, ভারতই আপাতত ফেক নিউজের রাজধানী।

তাতে কী-ই বা আসে? মোদি-শিষ্যরা যে কাজটা চাইছিলেন, তা ততক্ষণে সারা-দুনিয়াময় প্রচার। আজও নেট খুললেই দেখবেন, মোদির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিতে সওয়াল শুরু হয়েছে কীভাবে। বিভিন্ন সাইটে, বিভিন্ন স্টাইলে। অস্ত্র তোজের সেই ফেক কোট। ভারত বা প্রতিবেশী দেশে অধিকাংশ রাজনীতিকের অনুরাগীদেরই এমন অস্ত্র।

দেখেশুনে সেই পুরোনো আক্ষেপ ঘিরে ধরে আবার। খেলা-বিনোদনের বিশ্বে গত তিরিশ বছরে বহু বর্ণময় চরিত্র এসেছে অনুকরণ করার মতো। শুধু আদর্শ রাষ্ট্রনায়কদের তালিকায় খরা-ই। পৃথিবীকে পথ দেখানোর গুরুর সত্যিই অভাব। গান্ধি এবং ম্যান্ডেলার নামে ভারতে ফাউন্ডেশন হয় গান্ধির ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। ভাবা হচ্ছিল, নোবেল শান্তি ও সিওল শান্তি পুরস্কারের ঢংয়ে প্রতিবার সেরা চরিত্রকে বাছবে ফাউন্ডেশন। প্রথমবার ২০১৯ সালে নাম বাছতেই হিমসিম ফাউন্ডেশনের কর্তারা। মনোনয়নের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, চরিত্রের আকাল কী পর্যায়ে লালকৃষ্ণ আদবানি, কেনেথ কাউন্ডা, বহু আগে প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমান, ডন স্টিফেন সেনানায়েকের সঙ্গে সেখানে ছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়গপ্রসাদ অলি, বুরুন্ডির ফার্স্ট লেডি ডেনিস বুকুমি, টোগোর প্রধানমন্ত্রী কোমি সেলম ক্লাসু। এমনকি আমিরশাহি সরকারও। শেষমেশ পুরস্কার পান দলাই লামা। তারপর ওই পুরস্কারের উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। সম্ভবত চরিত্রের আকাল দেখেই।

পথ দেখানোর মতো চরিত্র, আদর্শ হয়ে ওঠা উদার গুরুরা আজ কোথায়, এই আর্ত চিৎকার ধ্বনিত এখন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরে। সাহারা থেকে অ্যামাজন, সুমেরু থেকে সাইবেরিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হিমালয়ে পথে পথে।

– রূপায়ণ ভট্টাচার্য

বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন  ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত