আজবার রহমান রাজ, খুলনা:
মুঠোফোন এখনকার সময়ে সবার জীবনের অপরিহার্য একটা বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে। মুঠোফোনের মাধ্যমে একজন মানুষ খুব সহজেই যে কোন জায়গা থেকে যে কারো সাথে খুব দ্রুত যোগাযোগ করতে পারছে। আধুনিক মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। মুঠোফোনের মাধ্যমে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। মুঠোফোনের ভাল দিক হল সহজে যোগাযোগ করা যায়। আর খারাপ দিক হল মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সময়ের অপচয়। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেলেও মুঠোফোনটা হাত থেকে রাখতে ইচ্ছা হয় না। আজকের শিশুকিশোরদের মাঝে মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার লক্ষণীয়।
আপনার বাচ্চা খেতে চাচ্ছে না। খুব সুন্দর করে হাতে মুঠোফোনটা ধরিয়ে দিয়ে কার্টুন কিংবা ভিডিও গেমস দিয়ে দিলে টপ টপ করে খেয়ে নিবে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক, তাই না? ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলেও এর ফলাফল হয়ে উঠতে পারে অনেক ভয়াবহ।
আজকাল শিশুকিশোররা অতীতের মতো আর দুরন্ত নেই। হারিয়ে গেছে তাদের দুষ্টুমি। মুঠোফোনের ভিতরেই খুঁজে নিয়েছে নিজেদের অন্য এক জগত। খেলার মাঠে খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। তাদের খুঁজলে পাওয়া যায় মুঠোফোন আর ভিডিও গেমসের ভিতরে।
শিশুরা খুবই আগ্রহী স্বভাবের হয়। তাদের যা শেখানো হয় তারা সেটা খুব দ্রুত শিখে নেয়। এই মুহূর্তে মুঠোফোনে চলে আসা ভিডিও গেমস আর কার্টুন এগুলা একটা শিশুদের বিকাশে দাড়িয়ে পড়েছে বাধা হিসেবে। একজন শিশু বা কিশোর এগুলার সংস্পর্শে এসে পারিপার্শ্বিক যোগাযোগ থেকে দুরে সরে যায়। তাদের মাঝে বেড়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা। পরবর্তীতে তারা একা একা থাকতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পারিপার্শ্বিক যোগাযোগ না থাকায় এবং একা একা বেড়ে ওঠায় তাদের ভিতর বিভিন্ন শারীরিক বিকলংগতা দেখতে পাওয়া যায়। দেখা দেয় মানসিক অবসাদ। তাদের শারীরিক অগ্রগতিতে হয়ে ওঠে অসুবিধা। আবার তাদের ভিতর বেড়ে যায় উগ্রতা।
আর এদিকে পড়াশোনায় ভালো ফলাফল অথবা ভালভাবে থাকার বিনিময়ে মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলার অনুমতি খুব সহজেই পেয়ে যায় শিশুরা। বিশেষ করে পেশাদার মায়েরা সন্তানদের হাতে মুঠোফোন ধরিয়ে দিয়ে এক রকম নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু তাতে যে তার সন্তানের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা হয় এ বিষয়ে নেয় কোন চিন্তাভাবনা।
“Kaiser Family Foundation” এর ২০১০ সালের একটা জরীপে দেখা যায় , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর কিশোরীদের মাঝে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের কাছে নিজস্ব মুঠোফোন রয়েছে। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। “Dhaka Tribune” এর ২০২১ এর একটা জরীপে বলা হয়েছে বাংলাদেশের কিশোরদের শতকরা ৯০ ভাগের কাছে ব্যক্তিগত মুঠোফোন রয়েছে। ” BRAC Institute of Governance and Development (BIGD)” এর একটা জরীপে বলা হয় , বাংলাদেশে অভিভাবকেরা ভয় পাচ্ছেন যে মুঠোফোন ব্যবহার করে তাদের সন্তানরা প্রেমের সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে মুঠোফোন পড়াশোনার কোন কাজে লাগছে না। কিশোররা হয়ে উঠছে উগ্র।
বর্তমান সময়ে মুঠোফোন ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি,খুলনার সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,”শিশুরা যেভাবে স্মার্টফোন অতিরিক্ত ব্যবহার করছে তাতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।” তিনি শিশুদের উপর মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রভাবকে তিনভাগে ভাগ করেন। প্রথমত শিশুদের শারীরিক নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে যেমন ঘুমের ঘাটতি, চোখের সমস্যা ও মাথার সমস্যা। দ্বিতীয়ত মানসিক বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিচ্ছে যেমন মোবাইল গেমিংয়ের কারণে তারা সহিংস আচরণ করছে, পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে, পড়াশুনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আর তৃতীয়ত সামাজিক প্রভাব। এখন মুঠোফোনের কারণে অনেক শিশুই সাইবার ক্রাইমের সাথে যুক্ত হচ্ছে, এবং অনেকেই মুঠোফোনের কারণে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকছে। এছাড়াও তিনি আরো বলেন,”আজকের শিশুই যেহেতু আগামীর সমাজকে নেতৃত্ব দিবে সুতরাং তারা যদি শারিরীক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে বড় হয় তবে তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে সমাজের উপরই পড়বে। তাই আমার ব্যক্তিগত অভিমত, শিশুরা স্মার্টফোন না চালানোই ভালো। তবে যদি প্রয়োজনে চালায়ও তবে সেটা সঠিকভাবে তদারকি করা উচিত বাবা মায়ের।”
এ ব্যাপারে খুলনা শিশু হাসপাতালের তত্বাবধায়ক এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ কামরুজ্জামান বলেন,”ডিজিটাল আসক্তির কারণে শিশুকিশোররা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে, অনেক সময় হাইপার হয়ে যাচ্ছে ”। ডিজিটাল আসক্তির এই অবস্থার পরিবর্তন করা যায় কিভাবে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, “এ ব্যাপারে কর্মজীবি মায়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তানদের মোবাইলে গেম খেলতে কম দিতে হবে। মাঝে মাঝে দিলে অসুবিধা নেয়।”
সন্তানদের মুঠোফোন আসক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে অভিভাবক খুশি বেগম বলেন, “সারাদিন শুধু মোবাইল আর মোবাইল। খাওয়া দাওয়া নাই পড়াশোনা নাই। তাদের লাগবে শুধু মোবাইল।”
এই মুহুর্তে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা আপনার কাছেই। তাকে কোন ভার্চুয়াল মাঠে খেলার ব্যবস্থা করবেন নাকি তাকে দিবেন খোলা মাঠে, খোলা পরিবেশে আলো বাতাসে খেলাধুলা করার সুযোগ।