মাদরাসা থেকে দাখিল বা কামিল পাস করেও হওয়া যায় ডাক্তার! এ জন্য লাগে শুধু পাঁচ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন অনেক চিকিৎসক। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিডিএস, এমফিল, পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ১৪৪টি বিষয়ে ডিগ্রি পাওয়া যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) নুরুল হক সরকার ওরফে শেখ গনি সরকারেরও (৭২) অনেক ভুয়া শিক্ষা সনদ রয়েছে।
গত বুধবার রাজধানীর মালিবাগের প্যারামাউন্ট টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুয়া ডিগ্রি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গনি সরকার ছাড়াও আটক হয়েছেন মোয়াজ্জেম হোমেন (৫৮), ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসক সাইদুর রহমান ওরফে নজরুল (৩০), মাহফুজুর রহমান ওরফে মাহফুজ (৩৭), আমান উল্লাহ (৩৮) ও দেবাশীষ কুণ্ডু (৫২)। তাঁদের কাছ থেকে অসংখ্য ভুয়া সনদসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছেন তদন্তকারীরা।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নুরুল হক ওরফে গনি সরকার সহযোগীদের নিয়ে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামে ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেছেন।
১৯৯৬ সাল থেকে তিনি অন্তত ২০০ ভুয়া চিকিৎসককে এমবিবিএস-বিডিএস সনদ দিয়েছেন। প্রতিটি এমবিবিএস সনদের জন্য নিয়েছেন পাঁচ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা। বিভিন্ন বিষয়ে দুই হাজার থেকে তিন হাজার ভুয়া সনদ বিক্রি করেছে নুরুল হকের সিন্ডিকেট। তিনি নিজেকে উপাচার্য হিসেবে পরিচয় দেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন ভুয়া সনদে চেম্বার খুলে রোগী দেখছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ভুয়া সনদপত্র, টেস্টিমোনিয়াল, ট্রান্সক্রিপ্ট, রেজিস্ট্রেশন কার্ড, অ্যাডমিট কার্ড, নকল সিলসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়। এসব কাগজে নূরুল হকের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদের সিল রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের চারটি চেক, ভুয়া সনদ দেওয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনের পেপার কাটিং ও লিফলেট, প্রেসক্রিপশন, অসংখ্য ভিজিটিং কার্ড, নবদিগন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড ডক্টরস চেম্বারের কপি জব্দ করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, বাস্তবে এমন কোনো বৈধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। নূরুল হকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্যও পেয়েছে ডিবি। আর ঢাকার সাভার, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী ও নারায়ণগঞ্জে ভুয়া এমবিবিএস চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি।
য়া ডিগ্রি দেওয়ার মূল ব্যক্তি নূরুল হকের দুই ছেলে ও এক মেয়ে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত জানিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, চক্রটি বিভিন্ন ডিগ্রির মোট দুই হাজার থেকে তিন হাজার সনদ বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ চক্রের কাছ থেকে যাঁরা সনদ নিয়ে ভুয়া চেম্বার খুলে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
ডিবি কর্মকর্তা আরো বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সাইদুর রহমান ওরফে নজরুল, মাহফুজ ও আমানুল্লাহ মাদরাসা থেকে দাখিল ও কামিল পাস করে এমবিবিএসের সনদ নিয়েছেন, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সাইদুর রহমান নজরুল সাভারে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন। মাহফুজ ডেন্টাল মেডিক্যাল থেকে পাস করা ভুয়া সনদ নিয়ে কুমিল্লায় চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া দেবাশীষ ডাক্তার পরিচয়ে টাঙ্গাইলে প্যাট্রিয়টিক আল্ট্রা মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে ‘বিটস ফর রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। আমানুল্লাহও সেই প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত।
ডিবি প্রধান বলেন, আরো অসংখ্য ব্যক্তির ভুয়া চিকিৎসা সনদসহ অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ে ভুয়া সনদ দেওয়া হয়েছে। নুরুল হক ওরফে এম এন হক পরিবারের সদস্যসহ অন্য সহযোগীদের সহায়তায় ভুয়া সনদ দেওয়ার একটি চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্র কোনো পরীক্ষা, ক্লাস ও বৈধ অনুমোদন ছাড়াই টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ১৪৪ ধরনের ভুয়া জাল সনদ তৈরি করে। চক্রটি প্রায় দুই দশক ধরে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির নামে ভুয়া সনদ বিক্রির ব্যবসা করে আসছিল। তারা ভুয়া ওয়েবসাইট, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়।
সংবাদ : কালের কণ্ঠ