ঢাকা ০৬:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ নয়নতারা মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত শ্যামনগরে হরিণের মাংস সহ আটক দুই সাতক্ষীরা সাস্থ্য উন্নয়ন কমিটির বর্ধিত সভায় ২৬ অক্টোবর খুলনা রোড মোড় মানব বন্ধনের সিদ্ধান্ত খুলনা প্রেসক্লাবে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি উপ-পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত কালিগঞ্জে জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান অনুষ্ঠিত  কালিগঞ্জে তরুন দলের কমিটি গঠন সভাপতি সুলতান,সম্পাদক আলতাপ পানি নিষ্কাশনে ইউএনও,র প্রাণপণ চেষ্টা অব্যহত তালার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন আবারও পানিবন্ধী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সঃ কে কটুক্তির প্রতিবাদে রূপসা বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত

এক হাতে ইফতার অন্য হাতে বাঁশি

  • Sound Of Community
  • পোস্ট করা হয়েছে : ০৩:৩৬:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০২২
  • ২৫২ জন পড়েছেন ।

তখনো রাস্তায় গাড়ির চাপ। চারপাশে হর্ন আর একটার পর একটা গাড়ির লম্বা সারি। ইফতারের সময়ও সন্নিকটে। পথচারীদের কারও হাতে হরেক রকম ফল, কারো হাতে আবার ইফতারের সরঞ্জাম। যে যেভাবে পারছেন ঘরে ফিরতে ব্যস্ত।

সারাদিন রোজা রেখে পরিবারের সাথে ইফতার করার আনন্দ ভাগাভাগি করতেই এই ছুটে চলা। সব কাজ ফেলে পরিবারের সাথে ইফতার করতে তাড়াহুড়ো থাকলেও ট্রাফিক সদস্যদের সে তাড়া একেবারেই ব্যতিক্রম।

তাদের জন্য নেই ভালোমানের ইফতারের আয়োজন। খাবার থাকলেও নেই বসার স্থান, আবার বসার স্থান থাকলেও নেই পর্যাপ্ত সময়। হালকা শুকনো খাবার অথবা শুধু পানি পান করেই শেষ হচ্ছে সিয়াম সাধনার প্রতিটি দিন। তা ছাড়া তারাবিহ সালাতের জন্যও নেই কোনো সুযোগ।

এত সব সমস্যার ভিড়েও ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তায় তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। সারা দিন রোজা রেখেও ইফতারের সময়টুকুতেও নেই বিশ্রাম। এক হাতে ইফতার আরেক হাতে বাঁশি নিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় তিন হাজারের অধিক ট্রাফিক সদস্য।

ইফতারের আগ মুহূর্তে পরিবার-পরিজন তাদের জন্য অপেক্ষা করলেও হার মেনেছেন দায়িত্বের কাছে। আদরের মেয়ের সাথে ইফতার করতে না করতে পারলেও তৃপ্তি খুঁজে পান নিরাপদে অন্যদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কাজ করে। তাদেরই একজন সার্জেন্ট খাইরুল আলম।

রাজধানীর জিপিও মোড়ের ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা সার্জেন্ট খাইরুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, পুলিশের চাকরিতে যেদিন যুক্ত হয়েছি সেদিন থেকেই ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের মানসিকতা নিয়েই এসেছি। ইফতারের সময় ঘরমুখো মানুষের চাপ এবং তাড়াহুড়ো খুব বেশি থাকে। সবাই চায় তাদের প্রিয়জনের সাথে ইফতারে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু আমাদের মা-বাবা, স্ত্রী-কন্যা থাকলেও তাদের সাথে ইফতারের সুযোগ মেলে না।

রোজার সময়ে সব প্রতিষ্ঠান প্রায় এক সাথেই ছুটি হয়, অন্য সময়ের থেকে এসময় তুলনামূলক যানজট বেশি থাকে। রাস্তায় যানজট রেখে আমাদের ইফতার করার সুযোগ নেই। আমাদের সিনিয়রদের নির্দেশনা তাড়াহুড়ো করে ইফতার করেই আবার দায়িত্ব পালন করা। এদিকে ইচ্ছা থাকার পরও আমাদের অনেকেই
তারাবির নামাজও পড়তে পারেন না, যথেষ্ট সময় পান না। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারকে বলি একসাথে ইফতার করব, কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আমাদের ইচ্ছা-অনুভূতি।

পরিবারকে কথা দিয়েও কখনো কখনো কল করে বলতে হয়— আজ যানজট বেশি, আসা হবে না! অপেক্ষা না করে তোমরা ইফতার করে নাও। বাসায় ছোট বাচ্চারাও পথ চেয়ে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ওদের অপেক্ষার পালাও বাড়তে থাকে। পরিবারের সাথে ইফতার করতে না পারার কষ্টটা এখন মেনে নিতে শিখেছি। পরিবারও বুঝে গেছে চাইলেই তারা আমাকে কাছে পাবে না। তাদের ইচ্ছা অনুভূতির জগৎটাকেও সংকুচিত করে নিয়েছে।

দৈনিক বাংলা মোড়ের একাধিক ট্রাফিক সদস্য জানান, আমাদের ট্রাফিক ডিভিশন থেকে একটি নির্ধারিত গাড়ি করে প্রতিটি ট্রাফিক বক্সে খাবার পৌঁছে দেন। ইফতারের সময় যানজট বেশি থাকায় একজন কনস্টেবলকে খাবার প্রস্তুত করার জন্য পাঠিয়ে বাকিরা রাস্তায় থাকি। আজান দিলেও দুজন কনস্টেবলকে সিগন্যালে রাখি। বাকিরা ইফতারে আসি তাড়াহুড়ো করে। পরে আমরা ফিরে গেলেই তারাও ইফতার করেন।

কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু সদস্য ভাইয়েরা থাকেন তারাও আমাদের সাহায্য করেন। একজন মানুষ ঘরে ফিরে ইফতার করতে পারলে আমাদের কাছে আনন্দের মনে হয়। কিন্তু আমরা পরিবারের সাথে ইফতারের তেমন সুযোগ পাই না। এই কষ্টটাকে আমরা ভেতর থেকেই মানিয়ে নিতে শিখেছি। জীবন হয়তো এমনি। মানুষকে নিরাপদে বাসায় ফিরতে সাহায্য করার মাঝেই এক অসম্ভব প্রশান্তি অনুভব করি। তাদের হাসিতেই আমাদের প্রাপ্তি। তাই কষ্টকেই আনন্দে রূপান্তর করেছি।

ইদের দিনে ছেলে যখন বলে আব্বু নামাজে যাবা না? কি উত্তর দেয়ার আছে তাকে? আমি পোশাক পরে ডিউটি তে যাচ্ছি। তখন ছেলেকে বুঝিয়ে আসতে হয় তুমি কাকা বা দাদুর সাথে নামাজে যাও। আমি বাইরে নামাজ পড়ে নেবো। তাদেরও প্রত্যাশা থাকে কিন্তু চাইলেই তো সব সম্ভব হয় না। আমি পুরুষ। আমি তো মানুষও। ইচ্ছা, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ আমারও আছে। একান্ত কিছু প্রত্যাশা আছে। কিন্তু কী লাভ বিষাদ বাড়িয়ে? অন্য এক সদস্য জানান, অনেক রোজার ঈদ আমি রাস্তায় করেছি। অনবরত বাচ্চারা বাসা থেকে কল দিচ্ছে কিন্তু আমার দায়িত্ব ফেলে যাওয়ার উপায় নেই।

এক সময় ওরাও বুঝে গেছে বাবা বোধ হয় এখন আসতে পারবে না। জীবন বোধ হয় এমনি, এভাবেই মেনে নিতে হবে। উৎসবের দিনগুলোতেও আমাদের ডিউটি বেশি। সবাই যখন হাসি তামাশায় মত্ত, পরিবারের সাথে একত্রে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঠিক তখনো আমরা কিছু মানুষের হাসির জন্য রাস্তায় থাকি। সবাই রাস্তায় বের হলেও আমরা পরিবার নিয়ে বের হতে পারি না। এই যে পহেলা বৈশাখ আসছে কিন্তু আমরা জানি – আমরা পরিবারকে নিয়ে একবেলা ঘুরতে যেতে পারব না। পোশাকের আড়ালে আমিও মানুষ, কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী।

গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা এক সদস্যের সাথে কথা হলে তিনি জানান, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে ইফতারের আগে একসাথে অনেক মানুষ ঘরমুখি হওয়াতে যানজট স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পায়। তাই এই সময়ে দায়িত্ব কিছুটা বেশি।

রমজানে প্রতিদিনকার ইফতারে অল্প সময় নিয়েই কোনোরকম শেষ করতে হয়। কিছু ছোলা, বুট, মুড়ি, একটি খেজুর এক বোতল পানি এই দিয়েই চলছে। তবে সারাদিন রোজা থাকার পর তৈলাক্ত খাবারের বিপরীতে তরল খাবারের সংখ্যা বাড়ালে ভালো হবে। ট্রাফিকে কাজ করতে গিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি অনেক। যতই কাজ করি কেউ অন্তত একটি ধন্যবাদ অবধি দিতে চান না। তবে কিছু মানুষ আছেন যারা খোঁজ নেন, ভালোবাসেন, সেবা পেলে ধন্যবাদ দেন।

গোলাপশাহ মাজারের ট্রাফিক বক্সে অন্য এক সদস্য বলেন, আমাদের জন্য যে খাবার দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়। এক বোতল পানি, একটা পেঁয়াজু, একটি আলুর চপ, একপিস কলা, খেজুর, মুড়ি, এসব শুকনো খাবার আসে। কিন্তু সারাদিন রোজা রেখে শরীর ক্লান্ত থাকে। এ খাবারের পাশাপাশি কখনো একটু ঠাণ্ডা পানি বা কিছু  ফল কিনে নেই। আমরা সবার জন্য পরিশ্রম করলেও আমাদের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই।

আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ফেরার পথকে আরও আনন্দঘন করতে কাজ করে যাই। কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা বা অপ্রাপ্তিগুলো কারো চোখে পড়ে না। এই যে রমজানে প্রিয়জনদের ছেড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় ইফতার করতে হয়। ইফতারের সময়ও ডিউটি চালিয়ে যেতে হয়। দায়িত্বের ফাঁকে কোনোভাবে রাস্তায়ই সেরে নিতে হয় ইফতার।

আবেগ এড়িয়ে দায়িত্ব, দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে দিনের পর দিন এ কষ্ট মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়েছি। তাঁতীবাজার ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা এক সদস্য জানান, ইফতারের চেয়েও বড় সমস্যা অনেক ট্রাফিক বক্সে ওয়াশরুম নেই। অনেক সদস্য আছেন ডায়াবেটিসের রোগী, তাদের সমস্যা আরও বেশি। বারবার ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন হয়। আশেপাশের দোকান বা শপিং মলের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়। এ  ক্ষেত্রে আমাদের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তারা কিছু না বললেও তাদের মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের উপস্থিতিতে তারা বিব্রত।

রমজানে খাবার খেতে হয় না বলে ওয়াশরুমের চাহিদা কম থাকলেও বছরের অন্য সময়গুলোতে বারবার পানি পান করা এবং খাবার খাবার কারণে ওয়াশরুমের বিড়ম্বনা প্রকট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি বক্সে ওয়াশরুম ব্যবস্থা করলে এ আমরা উপকৃত হবো।রাজধানীর ইত্তেফাক মোড়ে ট্রাফিক পয়েন্টে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য জানান, জনগণের জন্য আমরা চেষ্টা করি।

সংবাদ : দৈনিক আমার সংবাদ

Tag :
রিপোর্টার সম্পর্কে

Sound Of Community

জনপ্রিয় সংবাদ

আসুন সবাই মিলে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করি নবাগত জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ

এক হাতে ইফতার অন্য হাতে বাঁশি

পোস্ট করা হয়েছে : ০৩:৩৬:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০২২

তখনো রাস্তায় গাড়ির চাপ। চারপাশে হর্ন আর একটার পর একটা গাড়ির লম্বা সারি। ইফতারের সময়ও সন্নিকটে। পথচারীদের কারও হাতে হরেক রকম ফল, কারো হাতে আবার ইফতারের সরঞ্জাম। যে যেভাবে পারছেন ঘরে ফিরতে ব্যস্ত।

সারাদিন রোজা রেখে পরিবারের সাথে ইফতার করার আনন্দ ভাগাভাগি করতেই এই ছুটে চলা। সব কাজ ফেলে পরিবারের সাথে ইফতার করতে তাড়াহুড়ো থাকলেও ট্রাফিক সদস্যদের সে তাড়া একেবারেই ব্যতিক্রম।

তাদের জন্য নেই ভালোমানের ইফতারের আয়োজন। খাবার থাকলেও নেই বসার স্থান, আবার বসার স্থান থাকলেও নেই পর্যাপ্ত সময়। হালকা শুকনো খাবার অথবা শুধু পানি পান করেই শেষ হচ্ছে সিয়াম সাধনার প্রতিটি দিন। তা ছাড়া তারাবিহ সালাতের জন্যও নেই কোনো সুযোগ।

এত সব সমস্যার ভিড়েও ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তায় তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। সারা দিন রোজা রেখেও ইফতারের সময়টুকুতেও নেই বিশ্রাম। এক হাতে ইফতার আরেক হাতে বাঁশি নিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় তিন হাজারের অধিক ট্রাফিক সদস্য।

ইফতারের আগ মুহূর্তে পরিবার-পরিজন তাদের জন্য অপেক্ষা করলেও হার মেনেছেন দায়িত্বের কাছে। আদরের মেয়ের সাথে ইফতার করতে না করতে পারলেও তৃপ্তি খুঁজে পান নিরাপদে অন্যদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কাজ করে। তাদেরই একজন সার্জেন্ট খাইরুল আলম।

রাজধানীর জিপিও মোড়ের ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা সার্জেন্ট খাইরুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, পুলিশের চাকরিতে যেদিন যুক্ত হয়েছি সেদিন থেকেই ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের মানসিকতা নিয়েই এসেছি। ইফতারের সময় ঘরমুখো মানুষের চাপ এবং তাড়াহুড়ো খুব বেশি থাকে। সবাই চায় তাদের প্রিয়জনের সাথে ইফতারে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু আমাদের মা-বাবা, স্ত্রী-কন্যা থাকলেও তাদের সাথে ইফতারের সুযোগ মেলে না।

রোজার সময়ে সব প্রতিষ্ঠান প্রায় এক সাথেই ছুটি হয়, অন্য সময়ের থেকে এসময় তুলনামূলক যানজট বেশি থাকে। রাস্তায় যানজট রেখে আমাদের ইফতার করার সুযোগ নেই। আমাদের সিনিয়রদের নির্দেশনা তাড়াহুড়ো করে ইফতার করেই আবার দায়িত্ব পালন করা। এদিকে ইচ্ছা থাকার পরও আমাদের অনেকেই
তারাবির নামাজও পড়তে পারেন না, যথেষ্ট সময় পান না। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারকে বলি একসাথে ইফতার করব, কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আমাদের ইচ্ছা-অনুভূতি।

পরিবারকে কথা দিয়েও কখনো কখনো কল করে বলতে হয়— আজ যানজট বেশি, আসা হবে না! অপেক্ষা না করে তোমরা ইফতার করে নাও। বাসায় ছোট বাচ্চারাও পথ চেয়ে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ওদের অপেক্ষার পালাও বাড়তে থাকে। পরিবারের সাথে ইফতার করতে না পারার কষ্টটা এখন মেনে নিতে শিখেছি। পরিবারও বুঝে গেছে চাইলেই তারা আমাকে কাছে পাবে না। তাদের ইচ্ছা অনুভূতির জগৎটাকেও সংকুচিত করে নিয়েছে।

দৈনিক বাংলা মোড়ের একাধিক ট্রাফিক সদস্য জানান, আমাদের ট্রাফিক ডিভিশন থেকে একটি নির্ধারিত গাড়ি করে প্রতিটি ট্রাফিক বক্সে খাবার পৌঁছে দেন। ইফতারের সময় যানজট বেশি থাকায় একজন কনস্টেবলকে খাবার প্রস্তুত করার জন্য পাঠিয়ে বাকিরা রাস্তায় থাকি। আজান দিলেও দুজন কনস্টেবলকে সিগন্যালে রাখি। বাকিরা ইফতারে আসি তাড়াহুড়ো করে। পরে আমরা ফিরে গেলেই তারাও ইফতার করেন।

কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু সদস্য ভাইয়েরা থাকেন তারাও আমাদের সাহায্য করেন। একজন মানুষ ঘরে ফিরে ইফতার করতে পারলে আমাদের কাছে আনন্দের মনে হয়। কিন্তু আমরা পরিবারের সাথে ইফতারের তেমন সুযোগ পাই না। এই কষ্টটাকে আমরা ভেতর থেকেই মানিয়ে নিতে শিখেছি। জীবন হয়তো এমনি। মানুষকে নিরাপদে বাসায় ফিরতে সাহায্য করার মাঝেই এক অসম্ভব প্রশান্তি অনুভব করি। তাদের হাসিতেই আমাদের প্রাপ্তি। তাই কষ্টকেই আনন্দে রূপান্তর করেছি।

ইদের দিনে ছেলে যখন বলে আব্বু নামাজে যাবা না? কি উত্তর দেয়ার আছে তাকে? আমি পোশাক পরে ডিউটি তে যাচ্ছি। তখন ছেলেকে বুঝিয়ে আসতে হয় তুমি কাকা বা দাদুর সাথে নামাজে যাও। আমি বাইরে নামাজ পড়ে নেবো। তাদেরও প্রত্যাশা থাকে কিন্তু চাইলেই তো সব সম্ভব হয় না। আমি পুরুষ। আমি তো মানুষও। ইচ্ছা, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ আমারও আছে। একান্ত কিছু প্রত্যাশা আছে। কিন্তু কী লাভ বিষাদ বাড়িয়ে? অন্য এক সদস্য জানান, অনেক রোজার ঈদ আমি রাস্তায় করেছি। অনবরত বাচ্চারা বাসা থেকে কল দিচ্ছে কিন্তু আমার দায়িত্ব ফেলে যাওয়ার উপায় নেই।

এক সময় ওরাও বুঝে গেছে বাবা বোধ হয় এখন আসতে পারবে না। জীবন বোধ হয় এমনি, এভাবেই মেনে নিতে হবে। উৎসবের দিনগুলোতেও আমাদের ডিউটি বেশি। সবাই যখন হাসি তামাশায় মত্ত, পরিবারের সাথে একত্রে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঠিক তখনো আমরা কিছু মানুষের হাসির জন্য রাস্তায় থাকি। সবাই রাস্তায় বের হলেও আমরা পরিবার নিয়ে বের হতে পারি না। এই যে পহেলা বৈশাখ আসছে কিন্তু আমরা জানি – আমরা পরিবারকে নিয়ে একবেলা ঘুরতে যেতে পারব না। পোশাকের আড়ালে আমিও মানুষ, কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী।

গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা এক সদস্যের সাথে কথা হলে তিনি জানান, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে ইফতারের আগে একসাথে অনেক মানুষ ঘরমুখি হওয়াতে যানজট স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পায়। তাই এই সময়ে দায়িত্ব কিছুটা বেশি।

রমজানে প্রতিদিনকার ইফতারে অল্প সময় নিয়েই কোনোরকম শেষ করতে হয়। কিছু ছোলা, বুট, মুড়ি, একটি খেজুর এক বোতল পানি এই দিয়েই চলছে। তবে সারাদিন রোজা থাকার পর তৈলাক্ত খাবারের বিপরীতে তরল খাবারের সংখ্যা বাড়ালে ভালো হবে। ট্রাফিকে কাজ করতে গিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি অনেক। যতই কাজ করি কেউ অন্তত একটি ধন্যবাদ অবধি দিতে চান না। তবে কিছু মানুষ আছেন যারা খোঁজ নেন, ভালোবাসেন, সেবা পেলে ধন্যবাদ দেন।

গোলাপশাহ মাজারের ট্রাফিক বক্সে অন্য এক সদস্য বলেন, আমাদের জন্য যে খাবার দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়। এক বোতল পানি, একটা পেঁয়াজু, একটি আলুর চপ, একপিস কলা, খেজুর, মুড়ি, এসব শুকনো খাবার আসে। কিন্তু সারাদিন রোজা রেখে শরীর ক্লান্ত থাকে। এ খাবারের পাশাপাশি কখনো একটু ঠাণ্ডা পানি বা কিছু  ফল কিনে নেই। আমরা সবার জন্য পরিশ্রম করলেও আমাদের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই।

আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ফেরার পথকে আরও আনন্দঘন করতে কাজ করে যাই। কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা বা অপ্রাপ্তিগুলো কারো চোখে পড়ে না। এই যে রমজানে প্রিয়জনদের ছেড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় ইফতার করতে হয়। ইফতারের সময়ও ডিউটি চালিয়ে যেতে হয়। দায়িত্বের ফাঁকে কোনোভাবে রাস্তায়ই সেরে নিতে হয় ইফতার।

আবেগ এড়িয়ে দায়িত্ব, দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে দিনের পর দিন এ কষ্ট মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়েছি। তাঁতীবাজার ট্রাফিক বক্সে দায়িত্ব পালন করা এক সদস্য জানান, ইফতারের চেয়েও বড় সমস্যা অনেক ট্রাফিক বক্সে ওয়াশরুম নেই। অনেক সদস্য আছেন ডায়াবেটিসের রোগী, তাদের সমস্যা আরও বেশি। বারবার ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন হয়। আশেপাশের দোকান বা শপিং মলের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়। এ  ক্ষেত্রে আমাদের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তারা কিছু না বললেও তাদের মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের উপস্থিতিতে তারা বিব্রত।

রমজানে খাবার খেতে হয় না বলে ওয়াশরুমের চাহিদা কম থাকলেও বছরের অন্য সময়গুলোতে বারবার পানি পান করা এবং খাবার খাবার কারণে ওয়াশরুমের বিড়ম্বনা প্রকট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি বক্সে ওয়াশরুম ব্যবস্থা করলে এ আমরা উপকৃত হবো।রাজধানীর ইত্তেফাক মোড়ে ট্রাফিক পয়েন্টে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য জানান, জনগণের জন্য আমরা চেষ্টা করি।

সংবাদ : দৈনিক আমার সংবাদ