ডেক্স : সাউন্ড অব কমিউনিটি
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলায় পিরোজপুর মোড় থেকে যমুনা নদীর ধারঘেঁসা ইটভাটাগুলোর পাশ দিয়ে ছনকা, দেয়া ইত্যাদি গ্রামগুলো ঘোরার সময় রাস্তার ডানদিকে হঠাৎই চোখে পড়বে ‘সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদ’-র সাইনবোর্ড। হয়তো কৌতূহল জাগলো আপনার মসজিদটি দেখার। তাই বনকলমীর বেড়া ঘেরা ইটসোলিংয়ের রাস্তায় হাঁস-কুড়ো যাবার পথ বাঁচিয়ে কিছুদূর হেঁটে একেবারে গ্রামীণ,স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে আবিষ্কার করবেন অপূর্ব-সুন্দর নান্দনিক টেরাকোটার নকশায় নির্মিত প্রবাজপুর শাহী মসজিদ। প্রথম দর্শনে হয়তো বিস্ময়-ও কাজ করবে এই ভেবে – এই আগাগোড়া নোনাপানির দেশে টেরাকোটার কাজগুলো এখনো অক্ষত আছে!!
স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য ‘পরবাজপুর’ উচ্চারণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণের গল্প নিয়ে রয়েছে কিংবদন্তী। রাজা প্রতাপাদিত্যের সভাসদ পরবাজ খাঁ এই মসজিদ নির্মাণ করেছে বলে তাঁদের বিশ্বাস। তবে প্রবাজপুর শাহী মসজিদের মালিকানা নিয়ে খুলনা জর্জ কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিল। সেখান থেকে স্থানীয় জনগণ মসজিদের আদি দলিল ও ফরমাননামা উদ্ধার করেন। সেখান থেকে জানা যায় – সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হন নুরুল্লা খাঁ। যশোরের ফৌজদার থাকাকালীন তিনি যমুনা নদীর পাড়ে এই মসজিদ নির্মাণের দরুণ ৫০ বিঘা লাখেরাজ জমি দান করেন এবং স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ কাসিমকে এই মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। তারিখটি ছিল ১৯ রমজান, ১২০৪ হিজরি (২৫ মে ১৬৯৩)। তাই এই মসজিদটি বোধহয় ফরমাননামা প্রকাশের কিছু পরেই নির্মিত হয়েছিল।
পীরত্ব খানে খোদা সেবাইতের ভিত্তিতে ১৯২৮ সালে মসজিদটি ডি.এস.রেকর্ডভুক্ত হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় ওয়াকফ্ কমিশনের কাছে আবেদন সাপেক্ষে মসজিদের যাবতীয় সম্পত্তি ‘নুরুল্লা খাঁ ওয়াকফ্ এস্টেট’-র আওতাভুক্ত হয়। তবে পরবর্তীকালে দেশভাগের পরবর্তী সময়ে মসজিদের সেবাইতগণ পাট্টামূলে মসজিদের কিছু অংশ বিক্রি করে ইছামতী নদীর ওপারে মুসলিম অধ্যুষিত বশিরহাটে চলে যান। ১৯৬২ সালে মসজিদের জমিজমা এস.এ রেকর্ডভুক্ত হয়।
তবে ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক কারণে প্রবাজপুর গ্রাম-সংলগ্ন এলাকা বসতিহীন হয়ে পড়লে মসজিদটি গাছপালা আর মাটির নিচে ঢাকা পড়ে যায়। পরবর্তীতে হাজী সোহরাব আলীর চেষ্টায় ১৯৬৫ সালে মসজিদটির পুনরুদ্ধার এবং অবকাঠামো সংস্কার হয়। হয়। এরপর ১৯৮২ সালে স্থানীয় জনসাধারণের আবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ১৯৮৮ সালে কাজ শুরু করে পুরাতন বৈশিষ্টের আদলে নানাবিধ সংস্কার সম্পন্ন করে। তবে দুঃখের বিষয় হল, সেই লাখেরাজ ৫০ বিঘা জমি মসজিদের অংশে নেই আর। মসজিদের বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণ এখন মোটে ১ একর ৩ শতক।
এই তো গেল ইতিহাসের কথা। এবার আসি মসজিদটির অনন্য বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ স্থাপত্যরীতির কথায়। এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি গম্বুজকক্ষ এবং বারান্দা – এই দু’ভাগে বিভক্ত। গম্বুজযুক্ত পশ্চিম অংশটি বর্গাকার। পশ্চিম দেয়ালে দু’পাশে দুটি এবং মাঝখানে একটি মিহরাব রয়েছে। আরো রয়েছে পাঁচটি খিলান আকৃতির দরজা। মসজিদটির পূর্ব অংশে যে বারান্দা, তার ছাদে তিনটি অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ আছে। মসজিদটির উত্তর পাশে ঈদগাহ এবং পুকুর বিদ্যমান। মসজিদটির দেয়াল পলেস্তারা বিহীন এবং ফুলের প্রতিকৃতি সমৃদ্ধ কারুকার্যে পরিপূর্ণ। এছাড়াও রয়েছে মন্দিরের অনুরূপ রথ প্রক্ষেপণ। প্রবাজপুর শাহী মসজিদের কারুকার্যের সাথে সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর মিল পাওয়া যায় বিধায় কোন কোন প্রত্নবিশেষজ্ঞ একে ‘সুলতানী আমলের মসজিদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই একবারের জন্য হলেও এই মসজিদে আসুন আর ফুলেল টেরাকোটার কারুকাজের রাজ্যে হারিয়ে যান।
তথ্যসূত্র:
১.সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি – প্রফেসর মিজানুর রহমান
২.যশোহর খুলনার ইতিহাস (২য় খণ্ড) – সতীশচন্দ্র মিত্র
৩, সুস্মিত সাইফ আহমেদ